রেনেসাঁ কী?

রেনেসাঁ কী?

 

 

ভূমিকা: উনিশ শতক ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক সৃষ্টিশীল যুগ। এ সময়ে ইউরোপে যে উদারনৈতিক ভাবধারা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে তার প্রভাব পড়েছিল সমগ্র বিশ্বে। ভারতবর্ষও এর প্রভাবমুক্ত ছিল না। পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার দরুন ভারতীয় জনমানসে এক নবচেতনার জাগরণ ঘটেছিল। যার ফলে ভারতীয় জনগণ বৈদেশিক শাসন-শোষণ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে এবং নিজেদের ধর্ম ও সমাজের মধ্যে যে দোষত্রুটি ছিল তা দূরীভূত করে কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ভারতীয় জনমানসের এ নবজাগরণকে অনেকেই ইতালির রেনেসাঁসের সাথে তুলনা করেছেন। রেনেসাঁ বা রেনেসাঁস: সুযুক্তির পরে আসে জাগরণ, আর দীর্ঘ সুষুপ্তির ফলে ঘটে আত্মাবিলুপ্তি, তখন আসে চিরপতন, নতুবা পুনর্জন্ম বা নবজাগরণ। ইউরোপের মধ্যযুগের দীর্ঘ সুষুপ্তি যখন আত্মার লুপ্তিতে পর্যবসিত হয়েছিল তখনই ঘটেছিল এক ব্যাপক নবজাগরণ। যাকে ফরাসিতে বলা হয় রেনেসাঁস। আর সে নবজাগরণের অগ্রদূত ছিল ইতালি। ভারতবর্ষেও অনুরূপ উনবিংশ শতকে যে নবজাগরণ ঘটেছিল এর অগ্রদূত ছিল বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে বিদেশি ইংরেজ শাসনের প্রভাব আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং বুর্জোয়া অর্থনীতি বাংলার মানুষকে সর্বপ্রথম আলোড়িত করেছিল। এ আলোড়ন যে নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিল তাকে সাধারণভাবে বাংলার নবজাগরণ বা বঙ্গীয় রেনেসাঁস বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন পণ্ডিত রেনেসাঁস কথাটির বিভিন্ন অর্থ করেছেন।

বুরশাভ-এর মতে, “মধ্যযুগের ইউরোপের অন্ধবিশ্বাস, যুক্তিহীনতা ও কুসংস্কারের অচলায়তন থেকে ইউরোপবাসীর চিন্তা ও মননশীলতার মুক্তি ছিল পঞ্চদশ শতকের রেনেসাঁসের প্রাণশক্তি।” ব্যক্তির সার্বিক মুক্তি, প্রকৃতির বাস্তব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, অলৌকিক ও দেবী শক্তিতে বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা, মানবতাবাদ প্রভৃতি ছিল পঞ্চদশ শতকের ইতালির রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য।

মায়াসের মতে, “ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মূল লক্ষণ ছিল অনুসন্ধানী, যুক্তিবাদী, প্রশ্নকারী, আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর (১৪৫৩) কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রিক ভাষা সাহিত্য ও দর্শনের পণ্ডিতরা ইতালিতে চলে এলে এ রেনেসাঁস বা জগতের উদ্ভব হয়। মধ্যযুগের কুসংস্কার, আত্মবিশ্বাস ও দৈব শক্তির উপর প্রগাঢ় আস্থা ত্যাগ করে লোকে যুক্তি প্রমাণ ও বাস্তবতার ভিত্তিতে খোলা চোখে সকল কিছু বিচার করতে শেখে। ধর্মনিরপেক্ষতা, ইন্দ্রিয়বাদ, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ জনমানসকে আলোকিত করে। সাহিত্য, শিল্পে আসে অনুসন্ধানী মনোবৃত্তি। তার ফলে বিজ্ঞান গবেষণা ও ভৌগোলিক অধিকারের ক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতি ঘটে।

 

ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য, শিল্প, মননশীলতা, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতে যে নবজাগরণ ঘটে তা প্রথমে বাংলাদেশে দেখা দিলেও ক্রমে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর হিস্ট্রি অব বেঙ্গল দ্বিতীয় খণ্ডে স্পষ্ট ভাষায় ও দ্বিধাহীনভাবে উনবিংশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে রেনেসাঁস নামে অভিহিত করেন। ড. সরকার বলেন যে, “কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোগে যে রেনেসাঁস দেখা দেয়, উনবিংশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল তদাপেক্ষা ব্যাপক, গভীর এবং অধিকতর বৈপ্লবিক। এ নবজাগরণ ছিল প্রকৃতপক্ষে রেনেসাঁস। অধ্যাপক সরকার বলেন যে, বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন, বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে জাগরণ ঘটে তাকে সাধারণত রেনেসাঁস বলা হয়ে থাকে।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রেনেসাঁ ছিল নবজাগরণ, রেনেসাঁ জাগরণে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা, মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ইন্দ্রিয়বাদ, সবক্ষেত্রে আসে ব্যাপক নব পরিবর্তন। যা সমগ্র পৃথিবীতে নতুন চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণার জন্ম দেয় যা মানুষের অনুসন্ধানী মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। রেনেসাঁর মাধ্যমে সবদিকে দৃষ্টিভঙ্গির জাগরণ ঘটে।