ইফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়টি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ফরায়েজি আন্দোলন ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং জমিদার শ্রেণী ও নীলকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। প্রাথমিকভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলনকে সংগঠিত এবং পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ মহসীন ওরফে দুদু মিয়া এ আন্দোলনকে একটি কাঠামোগত রূপ দেন এবং খুব দ্রুত সমগ্র দেশব্যাপী বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। এভাবে একপর্যায়ে এ আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃতি: হাজী শরীয়তুল্লাহ মূলত ধর্মীয় আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হতে শেষ পর্যন্ত ফরায়েজি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকে প্রবাহিত হয়। তাই সার্বিকভাবে ফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃতিকে ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এ তিন দিক হতে ব্যাখ্যা করা যায়। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক. ধর্মীয় দিক: তৎকালীন সময়ে মুসলিম সমাজে বেশকিছু কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। কেননা এ সময়ে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের বেশিরভাগই ছিল পূর্বে হিন্দুধর্ম বা প্রকৃতির উপাসক। ফলে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও এদের মধ্যে পূর্ব ধর্মের প্রভাব থেকে যায়। হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলিম সমাজের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করে ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্য গ্রহণ করেন তাঁর পরিচালিত ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে। নিম্নে হাজী শরীয়তুল্লাহর ধর্মীয় সংস্কারগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্ধ ঘোষণা: তৎকালীন মুসলিম সমাজে যেসব অনৈসলামিক রীতিনীতি প্রচলিত ছিল
হাজী শরীয়তুল্লাহ সেগুলোকে মহাপাপ বলে আখ্যা দিয়ে তা না পালন করার নির্দেশ দেন। তিনি এ পাপকে বেদাত এবং শিরক দু’ভাগে ভাগ করেছেন। গাজী কালুর প্রশস্তি গাওয়া, খাঁজা খিজির দোহাই দেওয়া, জারিগান গাওয়া, মহরমের শোক ও মাতম করা ইত্যাদিকে বেদাত পাপ এবং পীর পূজা, কবর পূজা, মাজার জিয়ারত ইত্যাদিকে শিরক পাপ বলে ঘোষণা করেন। তিনি এসব পাপ হতে মুসলমানদের বিরত থাকার পাশাপাশি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
২. জুম্মার নামাজ পড়া ও ঈদ উদযাপন নিষিদ্ধকরণ: হাজী শরীয়তুল্লাহ ঘোষণা করেন বিধর্মী শাসিত রাষ্ট্রে জুম্মার নামাজ পড়া ও ঈদ উদযাপন ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। কেননা জুম্মার নামাজ আদায়ের প্রধান শর্তই দেশে ইসলামি শাসক এবং ইসলামি প্রশাসকের উপস্থিতি, যা এদেশে অবর্তমান। তাই হানাফী মাযহাব অনুসারে এদেশে ঈদ উদযাপন ও জুম্মার নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামি শাসন কায়েমের পক্ষে মত দেন।
খ. অর্থনৈতিক দিক : হাজী শরীয়তুল্লাহর জীবদ্দশাতেই ফরায়েজি আন্দোলনের প্রকৃতি কিছুটা অর্থনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ১৭৯ত হলে প্ররীতত চিরস্থায়ী বন্দোবন্তের ফলে যে নতুন জমিদার শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে তার বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। ফলে হিন্দু জমিদারগণ যখন মুসলমান প্রজাদের উপর বিভিন্ন অবৈধ কর ধার্য করে তখনই সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জমিদারদের সাথে যেসব বিষয় নিয়ে ফরায়েজিদের মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল তা হলো।। জমিদার কর্তৃক দুর্গাপূজা, কালীপূজা ও নানারকম হিন্দু উৎসবের জন্য মুসলমানদের উপর কর ধার্য এবং জমিদারের কর্মচারীদের দ্বারা এ কর জোরপূর্বক আদায়ের ফলে ফরায়েজিদের সাথে জমিদারের বিরোধ দেখা দেয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি কৃষকদের এসব অবৈধ কর প্রদান করতে নিষেধ করায় জমিদার ফরায়েজিদের উপর নানারকম অত্যাচার চালায়। নানারকম হিন্দু উৎসবের জন্য মুসলমানদের উপর কর ধার্যের পাশাপাশি মুসলমানদের দাড়ি রাখার উপরও কর ধার্য করা হয়। এ করের পরিমাণ ছিল জনপ্রতি আড়াই টাকা। হাজী শরীয়তুল্লাহ এ কর প্রদান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলে জমিদার ও ফরায়েজিদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে।
হিন্দু জমিদার মুসলমানদের ঈদ উপলক্ষে গরু কুরবানি নিষিদ্ধ করে এবং হাজী শরীয়তুল্লাহ এ আদেশ অমান্য করার আহ্বান জানান। ফলে জমিদারের সাথে ফরায়েজিদের মতভেদ দেখা দেয়। এ মতভেদে জমিদারের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ায় তারা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধাচরণ ও নানারকম অত্যাচার শুরু করে। অবশ্য জমিদারের এ জুলুম ফরায়েজিদের কোন ক্ষতি তো সাধন করতে পারে নি, বরং ফরায়েজিদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে কৃষক শ্রেণী দলে দলে ফরায়েজিদের সাথে যোগদান করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের কুসংস্কার থেকে মুক্তির আন্দোলন। তৎকালীন সমাজে যে সকল কুপ্রথা ও অনৈসলামিক রীতিনীতি প্রচলিত ছিল যে সকল কর্মকাণ্ড থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে বিরত রাখা এবং মুসলমান সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় এ আন্দোলন একটি কাঠামোগত রূপ লাভ করে।