ফরায়েজি আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

ফরায়েজি আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

 

 

ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়টি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ফরায়েজি আন্দোলন ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং জমিদার শ্রেণী ও নীলকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। প্রাথমিকভাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলনকে সংগঠিত এবং পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ মহসীন ওরফে দুদু মিয়া এ আন্দোলনকে একটি কাঠামোগত রূপ দেন এবং খুব দ্রুত সমগ্র দেশব্যাপী বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। এভাবে একপর্যায়ে এ আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

 

ফরায়েজি আন্দোলনের পটভূমি: যে কোন আন্দোলনেরই কিছু কারণ থাকে। অনেকগুলো কারণ একত্র হয়েই একটি আন্দোলনের পটভূমি সৃষ্টি করে। তেমনি ফরায়েজি আন্দোলনের পশ্চাতেও কিছু কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে ফরায়েজি আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা করা হলো:

 

১. মুসলিম সম্প্রদায়ের অনগ্রসরতা: বক্সারের যুদ্ধে মীরকাসিমের পরাজয় এবং ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা লাভের পরবর্তী সময় থেকেই ভারতীয় মুসলিম সমাজের অবক্ষয় শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার হিন্দু সম্প্রদায়কে একটু বেশি প্রাধান্য দেয়ার ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান জাতি ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। এভাবে এক সময়ে সম্প্রদায়টি অনগ্রসর, অশিক্ষিত ও দরিদ্র সম্প্রদায়ে পরিণত হয় এবং সমাজের অবহেলিত জাতি হিসেবে বসবাস করতে থাকে।

 

২. ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা: ক্ষমতা গ্রহণের পর ইংরেজ কোম্পানি ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা চালু করে। কিন্তু এ সময়ে মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজি ভাষাকে বিধর্মীর ভাষা বলে চিহ্নিত করে এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করার পক্ষে মত দেয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে চালু করলে বহু মুসলমান কর্মচারী চাকরি হারায়। এর ফলে চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়ে।

 

৩. অর্থনৈতিক দুরবস্থা: ভারতীয় উপমহাদেশের যশোর, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যখন এসব এলাকার চাষিদের দিয়ে জোরপূর্বক নীল চাষ শুরু করে, তখন এ মুসলিম সম্প্রদায় ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।।

 

৪. অযৌক্তিক কর ধার্য: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজ অনুগত হিন্দু জমিদারগণ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর অবশ্য নির্যাতন চালায়। পূজার সময় মুসলমান কৃষকদের নিকট হতে খাজনা আদায় এবং দাড়ি রাখার জন্য মুসলমান কৃষকদের কর প্রদান করতে বাধ্য করা হয়। এতে করে মুসলিম কৃষকগণ নিঃস্ব হতে আরো নিঃস্বতর হয়ে পড়ে।

 

 

 

৫. ধর্মীয় কুসংস্কার: সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ সময়ে অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ধর্মান্তরিত হলেও এদের মধ্যে কুরআন ও হাদিসের পরিপন্থী পূর্ব ধর্মজাত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে সমাজে ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

 

৬. অন্যান্য আন্দোলন: ব্রিটিশ অনুগত হিন্দু জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমান কৃষকগণ এ শোষণমূলক প্রশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করে। যেমন- রংপুর বিদ্রোহ, শেরপুর বিদ্রোহ, যশোর বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। এসব আন্দোলন কৃষক শ্রেণীকে আরো সচেতন করে তোলে।

 

ফরায়েজি আন্দোলনের নামকরণ: আরবি ‘ফরজ’ শব্দ থেকে ফরায়েজি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। এ অর্থে ফরায়েজি আন্দোলনের অর্থ ছিল আল্লাহর আদেশসমূহের ভিত্তিতে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে আত্মশুদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্মে অবশ্যকরণীয় বা পাঁচটি ফরজ পালনের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন বলেই এ আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে ফরায়েজি আন্দোলন।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ শোষকদের জুলুম, অত্যাচার, শোষণ রাজস্ব বৃদ্ধি প্রভৃতির মাধ্যমে জর্জরিত মুসলমান সম্প্রদায় তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা উপেক্ষিত হয় চরমভাবে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হীনতা কাজ করে এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরই পেক্ষাপটে মুসলমান সম্প্রদায়ের সামনে মুক্তির আলোকবর্তিকা স্বরূপ হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। মুসলমান সম্প্রায়কে কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং আত্মশুদ্ধির জন্য ফরায়েজি আন্দোলন পরিচালিত হয়।