সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য Features of Military Rule
সামরিক শাসনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সব রাষ্ট্রে এক রকম নয়। রাষ্ট্রভেদে সামরিক শাসনের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এটি নির্ভর করে রাষ্ট্রের আর্থ- সামাজিক অবস্থান, বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রসার, রাজনৈতিক কাঠামোর কার্যকারিতা ও শক্তি প্রভৃতির উপর। তবে সর্বত্রই সামরিক শাসকগণ সামরিক শাসন জারি করার পর কতিপয় অভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন। যেমন-
১. সংবিধান রহিতকরণ (Suspension of Constitution)
২. মন্ত্রিসভা বরখাস্ত (Dissolution of the Cabinet)
৩. আইনসভা বাতিল (Dissolution of Parliament)
৪. শাসন পরিষদ গঠন (Formulation of Ruling council)
৫. অধ্যাদেশের মাধ্যমে শাসন (Ruling of Decree)
এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেনা শাসকরা স্বীয় ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়। যদিও তারা ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে বলে থাকে, একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন। পৃথিবীর অনেক দেশে সামরিক শাসকেরা কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে তথাকথিত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করেছে। অনেক দেশে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসনের অবসান ঘটেছে। রাষ্ট্রভেদে সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সামরিক শাসনের কতিপয় অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. সামরিক একনায়কত্ব ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন: সামরিক শাসনামলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেশ থেকে রাজনীতি উচ্ছেদ করে সামরিক এনায়কত্ব কায়েম। এ লক্ষ্যে সামরিক শাসকগণ সামরিক শাসন জারির পরপরই মন্ত্রিসভা বরখাস্ত, আইনসভা বিলুপ্ত এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রকে সামরিক শাসকের পূর্ণ কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসা হয়। সামরিক শাসনামলে জনমতকে উপেক্ষা করা হয়। সামরিক জান্তার হাতেই সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। ফলে সামরিক শাসনামলে কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনের সৃষ্টি হয়।
২. আমলাতন্ত্রের সামরিকীকরণ: আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। আমলারা তাদের পেশাগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যে কোন সরকারের সুনাম ও স্থায়িত্ব বহুলাংশে আমলাদের উপর নির্ভরশীল। সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সিভিল প্রশাসনে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এতে রাষ্ট্রকাঠামোতে আমলাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতাও ক্ষুণ্ণ হয়। সামরিক শাসকগণ জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাদেরকে সার্বিকভাবে আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন সংস্থাসমূহে আমলা আধিপত্য অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগের ফলে রাষ্ট্র ও সরকারের সামরিকীকরণ প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়।
৩. রাজনৈতিক দমন পীড়ন: রাজনৈতিক দমন পীড়ন ও নির্যাতন সামরিক শাসনের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। সামরিক শাসকগণ ক্ষমতা দখলের পর প্রথমে যে কাজটি করে তা হলো রাজনৈতিক দল কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি। এ সময় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানি, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন করা হয়, বিরোধী পক্ষের উপর চলে নির্যাতনের স্টিমরোলার। ছাত্র রাজনীতিকেও নির্মমভাবে দমন করার চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজরদারি বৃদ্ধি পায়। এ সময় সাধারণ আইন আদালতের তোয়াক্কা করা হয় না। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের নামে চালানো হয় নিপীড়ন, নির্যাতন। বিরোধীপক্ষকে দমন করার জন্য যে কোন কর্মকাণ্ডকে বৈধতাদান করা হয়। বস্তুত সামরিক শাসন কোন কোন ক্ষেত্রে স্বৈরশাসনকেও হার মানায়।
সামরিক বাহিনীর দাপট: সামরিক শাসনামলে সামরিক বাহিনীর দাপট ও দৌরাত্ম্য অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এ সময় সামরিক বাহিনীকে তার পেশাগত উৎকর্ষের চেয়ে করপোরেট স্বার্থরক্ষা, অধিকার সুবিধা আদায়, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষশাতায় অংশীদারিত্বের ব্যাপারে অধিক সক্রিয় হতে দেখা যায়। বস্তুত সামরিক শাসকগণ স্বীয় ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে অধিক সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মূলত সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রভৃত দাপট ও একচেটিয়া কর্তৃত্বের কারণে রাষ্ট্র একটি গ্যারিসন স্টেট (Garrison State)-এ পরিণত হয়।
৫ সংবিধান রহিতকরণ ও মৌলিক অধিকার খর্ব: সাধারণত সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে সংবিধান রহিত করা হয়। এর কারণ হলো সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখল। কারণ কোন দেশের সংবিধানে সেনাশাসনকে বৈধরূপে জ্ঞান করে না। এজন্য সামরিক শাসনামলে সংবিধান রহিত থাকে। পাশাপাশি জনগণের মৌলিক অধিকারও খর্ব করা হয়। সংগঠন করা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, স্বাধীন মত প্রকাশ করা এসব কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকে। কোন কোন সামরিক শাসক সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করলেও প্রয়োজনীয় ধারা নিজের অনুকূলে সংশোধন করে নেয়। কেউ কেউ নতুন সংবিধান রচনারও চেষ্টা করে। পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার ১৯৬২ সালে সংবিধান তৈরি করে।
৬. অধ্যাদেশের মাধ্যমে শাসন: সামরিক শাসন জারির ফলে আইনসভা বাতিল কর হয় বিধায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক শাসকগণ অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করেন। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো অধ্যাদেশ জারি করে থাকেন। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে আইসসভাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমন কি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন আইনসভা গঠন করা হলেও সেটিকে সামরিক জান্তার একান্ত রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল আইনসভার অনুপস্থিতিই হচ্ছে সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য। এ. শাসন পরিষদ গঠন: সামরিক শাসকগণ যেহেতু বৈধ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। সেহেতু তারা প্রথমেই সেই সরকারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে দেশ পরিচালনায় অযোগ্যতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ আনয়ন করা হয়। মন্ত্রিসভার পরিবর্তে সামরিক শাসকগণ সেনাবহিনী কখনও কখনও দলছুট নেতাদের সমন্বয়ে একটি শাসন পরিষদ গঠন করে দেশ পরিচালনা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে শাসন পরিষদের হাতে তেমন কোন ক্ষমতা থাকে না। তারা মূলত সামরিক একনায়কের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে।
৮. গণভোট/ আস্থা ভোট: প্রত্যেক সামরিক শাসকই দেশ শাসনের এক পর্যায়ে স্বীয় ক্ষমতাকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে আস্থা ভোট বা গণভোটের আয়োজন করে। তাদের উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করা। কিন্তু সে নির্বাচনও প্রহসনে পরিণত হয়। কারণ এতে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে না। অধিকাংশ
সামরিক শাসকই ভোটারবিহীন ভোট কেন্দ্রে ভোটের বাক্সে পূর্বে ব্যালট বোঝাই করে বা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল প্রচার করে বা গণ জাল ভোটের মাধ্যমে স্বীয় বিজয় নিশ্চিত করেছে। এর ফলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং নির্বাচন নামক প্রক্রিয়াটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
৯. প্রহসনের নির্বাচন: সামরিক শাসনামলে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাব্যাপকা জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারে না। সাধারণভাবে সেনাশাসকগণ বেসামরিকীকরণ (Civilianization) প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণভোট, স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে থাকে। কিন্তু সেনাশাসনামলের নির্বাচনগুলো বৈধতা পায় না। এর কারণ হলো প্রতিটি নির্বাচন প্রহসনে পর্যবসিত হয় এবং জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্ট হয়। বস্তুত সামরিক শাসকদের অধীনে কখনই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। যেহেতু জনগণ সামরিক শাসনকে পছন্দ করে না,তাই তার পক্ষে সমর্থন ও ব্যক্ত করে না। এমতাবস্থায়, সামরিক শাসকগণ নির্বাচনি কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।
১০. বৈধতার সংকট: সামরিক শাসকগণ সর্বদাই বৈধতার সংকটে ভোগে। বৈধতার সংকট বলতে শাসন ক্ষমতার বৈধ প্রকৃতি এবং সরকারের ক্ষমতা বিষয়ে মতৈক্যের সমস্যাকে বুঝায়। সরকারের প্রতি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের অভাবে বৈধতার সংকট দেখা দেয়। সামরিক শাসকগণ অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে বিধায় সামরিক শাসনামল বৈধতা পায় না। এমন কি বারবার নির্বাচন দিয়ে অনেক সামরিক শাসক বৈধতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহ অবাধ ও নিরপেক্ষ না হওয়াতে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে নি।ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার আস্থাহীন তা সামরিক সরকারের বৈধতাকে আরো বেশি সংকটাপন্ন করে তোলে।
১১. রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা: সামরিক শাসন অধিকাংশ দেশে নোংরা ও আদর্শহীন রাজনীতি সূত্রপাত ঘটায়। বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে বা রাজনীতিবিদদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করে সপক্ষে আনার চেষ্টা করে রাজনীতিতে এক আদর্শহীনতার জন্ম দেয়। অনেক সামরিক শাসকই প্রথম দিকে রাজনৈতিক দলের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও শেষাবধি নিজেই রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। সাধারণত দলছুট এবং আদর্শহীন, বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের জড়ো করে নতুন দল গঠন করে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান এরূপ ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।
১২. ব্যাপক গণঅসন্তোষ: সামরিক শাসনামলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট যেমন অর্থনীতির ধ্বংস সাধন করে তেমনি রাজনীতিতেও নতুন করে অস্থিরতার জন্ম দেয়। ফলে দেশে বিনিয়োগ কমে যায়, বেকারত্ব বাড়ে, মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে ব্যাপক গণ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ সামরিক শাসককে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।