লর্ড মেকলে কে? তিনি ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে বেশি আগ্রহী ছিলেন কেন?
ভূমিকা: মধ্যযুগে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক বেশি ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তখন আরবি, ফারসি, বাংলা ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হতো। ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি প্রয়োগ করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়। এ সময় তারা পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করে। ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে যাদের অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে লর্ড মেকলে অন্যতম।
নিম্নে প্রশ্নালোকে লর্ড মেকলে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
লর্ড মেকলের পরিচয়: লর্ড মেকলে জ্ঞান শিক্ষা সাধারণ সমিতি (General committee of public instruction)-এর সভাপতি ছিলেন ১৮৩৪ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় আরবির সাথে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবকে ভিত্তি করে ১৮৩৫ সালে শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে জনশিক্ষা সাধারণ সদস্যদের মধ্যে তুলুম বির্তকের সৃষ্টি হয়। সদস্যগণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায় একদল প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থক ও অন্যদল পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থকগণ মনে করেন যে, ভারতীয়দের জন্য তাদের প্রাচীন শিক্ষা বজায় রাখা উচিত এবং এ শিক্ষার সাথে তাদের নিজেদের ভাষায় কিছুটা ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করলে তারা উপকৃত হবে। পাশ্চাত্য পন্থিগণ ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লর্ড মেকলে। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। জনশিক্ষা সাধারণ সমিতির সভাপতি হিসেবে লর্ড মেকলের প্রভাব একটু বেশিই ছিল। তাই এ সমিতির মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষা চালু করতে সক্ষম হন।
লর্ড মেকলে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে বেশি আগ্রহী হওয়ার কারণ: প্রাচ্য শিক্ষার প্রতি লর্ড মেকলের সংকীর্ণ ধারণা ছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তার ছিল উদার মনোভাব। এটি ছিল তার ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে আগ্রহী হওয়ার প্রধান কারণ। তিনি বলেন, “একটি ভালো ইউরোপীয় লাইব্রেরির এক সেলফের বই-এর মূল্য ভারতীয় ও আরবি সাহিত্যের সমস্ত গ্রন্থের মূল্যের সমান।”
ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত হলে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে যেসব রাজনৈতিক সুবিধার সৃষ্টি হবে সেগুলোর প্রতিও তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, “ইংরেজি শিক্ষার ফলে ভারতে এক শ্রেণির লোক সৃষ্টি হবে যারা রক্তে ও রঙ্গে ভারতীয় থাকবে; কিন্তু রুচি, চিন্তাধারা, নৈতিক জ্ঞান ও বুদ্ধি বৃত্তিতে ইংরেজ হয়ে পড়বে।” অর্থাৎ ভারতীয়দেরকে ইংরেজ সভ্যতার ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হওয়ার জন্য ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে আগ্রহী হন। এতে ইংরেজরা সহজেই ভারতে তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে পারবে।কোন কোন ইংরেজ মনে করতেন যে, ইংরেজি শিক্ষা প্রচলিত হলে ভারতীয়দের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রসারের সুবিধা হবে। চার্লস গ্রান্টকে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার জনক বলা হয়। কারণ তিনি ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে খুব উৎসাহী ছিলেন। ১৭৯২ সালে তিনি পার্লামেন্টে বলেন, প্রকৃতি সম্বন্ধে সত্যিকার জ্ঞান বিচ্ছুরিত হলে হিন্দুধর্মের ভিত্তি ধসে পড়বে, যান্ত্রিক আবিষ্কারের জ্ঞানের আলোকে ভারতীয়গণ উদ্ভাসিত হবে এবং ক্রমশ পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের স্থলে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠাতা হবে। লর্ড মেকলেও এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন। তিনি তাঁর মাতাকে লিখেছিলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আমরা এ শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলন করি তাহলে ত্রিশ বছরের পরের বাংলায় কোন পৌত্তলিক থাকবে না।
উইলিয়াম বেন্টিংক মেকলের সাথে একমত পোষণ করেন। ১৮৩৫ সালে ৭ মার্চ ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে প্রস্ত এব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারত সরকার ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহ দান করবে এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ শুধু ইংরেজি শিক্ষায় ব্যয় করবে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটেএ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, লর্ড মেকলে ছিলেন একজন সত্যিকারের ইংরেজ। যা তার কর্মে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলে ভারতবর্ষের জনগণকে নিখুঁত ইংরেজ জাতিতে পরিণত করতে। তাই তিনি ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। ফলে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।