ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না কেন?

ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না কেন?

 

 

ভূমিকা: ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতক ছিল ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ নীতি বাস্তবায়নের শতক। এসময় তাদের সাম্রাজ্যবাদ নীতির কবলে পড়ে বহু দেশ হারিয়েছে তাদের নিজ নিজ শিক্ষা ও সংস্কৃতি। ভারতও তখন রক্ষা পায় নি তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির আগ্রাসন থেকে। ভারতে ইংরেজরা তাদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এসময় তারা ভারতে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা ছিল মুসলমানদের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাই তারা তাদের এ শিক্ষাব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারে নি।ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ: ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

 

১. মুসলিম স্বার্থ বিরোধী: ব্রিটিশ সরকার ভারতে যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করে তা মুসলমানদের জন্য উপযোগী ছিল না। এ সম্বন্ধে ই. সি. বেইলী বলেছেন, “শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ ছিল, এটি প্রবর্তন করার সময় তাদের সংস্কার সম্বন্ধে কোন রূপ বিবেচনা করা হয় নি এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করা হয় নি। এ জন্য শিক্ষাপদ্ধতি তাদের স্বার্থের পরিপন্থি ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতিকূল হয়ে পড়ে।”

 

 

২. ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের মঞ্চপুত নয়: ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতি মুসলমানদের মনঃপুত হয় নি। বেইলি মন্তব্য করেছেন, “সত্য কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, আমাদের জনশিক্ষা পদ্ধতি তিনটি বিষয়ে মুসলমানদের প্রবল মানসিক বৃত্তি উপেক্ষা করেছে।” তিনি আরো বলেছেন, বিদেশি ভাষায় শিক্ষা মুসলমানদের মনঃপুত হয় নি।

 

৩. ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনীহা: মুসলমানদের ধর্মীয়শিক্ষার ব্যাপারে ইংরেজরা অনীহা প্রকাশ করে। গ্রাম্য বিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষা দেয়া হতো তা মুসলমান ছাত্রদেরকে মর্যাদার আসনে বসাতে পারতো না এবং ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে সাহায্য করতো না। জেলা স্কুলগুলোতে আরবি-ফারসি শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। জনশিক্ষা পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থায় কোন পর্যায়ে ধর্মীয়শিক্ষার কোন স্থান ছিল না, যেখানে মুসলমানগণ সাধারণ শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষাকে অত্যাবশ্যক মনে করতো।

 

৪. নিজস্ব অর্থায়নে লেখাপড়া করা: ইংরেজ সরকার ছাত্রদের নিজস্ব অর্থায়নে লেখাপড়া করার নীতি চালু করে। এটি ছিল মুসলমানদের নিকট ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার অন্যতম কারণ। ছাত্রদের নিকট হতে কড়াকড়িভাবে বেতন আদায় করা হতো। পাঠ্যপুস্তক ব্যয় সাধ্য ছিল। আর্থিক অসঙ্গতির দরুন মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে বিদালয়ে পড়ার খরচ বহন করা কঠিন ছিল। সরকারের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই লেখাপড়া করতে পারত।

 

৫. মুহসিন ফন্ডের অপব্যবহার: হাজী মুহাম্মদ মুহসিন তার সমস্ত সম্পত্তি মুসলমানদের শিক্ষার জন্য উইল করে দেয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এ সম্পত্তি মুসলমানদের শিক্ষার জন্য ব্যয় না করে এর এক অংশ সরকারের ব্রিটিশ কর্মকর্তারা গ্রহণ করতো এবং বাকী অংশ বিভিন্ন স্কুল কলেজে ব্যয় করা হতো, যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল খুবই কম। ফলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মুসলমানদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

 

৬. শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশ্রেণির শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: ইংরেজরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেবল তাদের জন্যই শিক্ষারব্যবস্থা করে যাদের দ্বারা তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হবে। কেবলমাত্র উচ্চ শ্রেণির লোকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা সরকারের শিক্ষা নীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। ফলে মুসলমানদের নিকট ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হয় নি।

 

৭. সরকারি সাহায্যের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক শর্তারোপ: শিক্ষার ব্যাপারে সরকার যে আর্থিক সাহায্য করতো তাতে মুসলমানদের উপকার হতো না। স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা ছিল। এর জন্য একটি অযৌক্তিক শর্ত ছিল। শর্তটি হলো স্থানীয় লোকজন নিজদের সামর্থে স্কুল স্থাপন করতে পারলে এর জন্য সরকারি সাহায্য দেয়া হতো। সংগতিহীন মুসলমানগণ এ শর্ত পূরণে সক্ষম ছিলেন না। অবস্থাপন্ন হিন্দুরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সরকারি সাহায্যের সুবিধা লাভ করে।

 

৮. কলকাতা ও শহর কেন্দ্রিক স্কুল কলেজ স্থাপন: আগেই বলা হয়েছে যে, রাজধানী ও জেলা শহরগুলোর অবস্থাপন্ন ও উচ্চ শ্রেণির লোকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা ব্রিটিশ শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। সরকার মনে করতো যে, উচ্চ শ্রেণির লোক শিক্ষাপ্রাপ্ত হলে তারা পরে গ্রামে শিক্ষাবিস্তার করবে। এ নীতির ফলে অধিকাংশ স্কুল ও ফলেজ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতায় মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম ছিল। তারা সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা হতে উপকার পায় নি কোন কোন শহরে জেলা স্কুল স্থাপন করা হয়। এসব শহরে মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যা কম ছিল। শহরের স্কুলগুলোতে শিক্ষা লাভ করা গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার শিক্ষার প্রতি সরকার উদাসীন ছিল। এজন্য এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানগণ শিক্ষার সুযোগ পায় নি।

 

৯. হিন্দুদের সুযোগ বৃদ্ধি: ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুদের লেখাপড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়। তাদের জন্য আলাদা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানে যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান করা হতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু ছাত্রদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো। মুসলমান ছাত্রদের সুযোগ হ্রাস করা হয়। ভর্তির ক্ষেত্রেও তাদের সাথে বৈষম্য করা হতো। এসব কারণে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ ছিল না।

 

উপসংহার: পরিশেষে বরা যায় যে, ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। হিন্দু ও ব্রিটিশ উভয়েরই ইচ্ছা ছিল সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে রাখতে। এজন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমানরা যথাযথভাবে তাদের শিক্ষার অধিকার পায় নি। ইংরেজ সরকার কলকাতা মাদারাসা প্রতিষ্ঠা করলেও তাতে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না।