মুঘল যুগের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা কর।

মুঘল যুগের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা কর।

 

 

মুঘল যুগের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা কর।

 

ভূমিকা : মুঘল আমলে শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। এ সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন প্রভৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী।মুঘল যুগে শিক্ষাব্যবস্থা: নিম্নে মুঘল আমলের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

 

স্কুল কলেজ: মুঘলযুগে তিন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। যথা: ১. স্কুল ও কলেজ; ২. মসজিদ ও মঠ এবং ৩. প্রাইভেট গৃহাদি। এ সময় হিন্দু-মুসলিম সকলে মিলেমিশে লেখাপড়া করতো। ঐতিহাসিক সিদ্দীক বলেন, “হিন্দু ও মুসলিম ছাত্ররা পাশাপাশি বসে লেখাপড়া করতো এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য রচনা করা হতো না।” (Hindu students study side by side with Muslims and no restrictions were placed.”) আকবর আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে এবং শাহজাহান দিলিতে কলেজ স্থাপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক সিদ্দীক আরো বলেন, “আকবরের রাজত্বকালে স্কুল ও কলেজসমূহে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হয়।” (“Akbar’s reign marks a new epock for the system introduced for importing education in schools and colleges.”) ইসলাম শিক্ষা : মুঘল আমলে ইসলামি

 

শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি সাধন হয়। গুজরাট মুঘল অধিকারে আসায় ভারতবর্ষের মুসলমানরা সমুদ্রপথে আরবদেশে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং আরবদের সান্নিধ্যে এসে তাঁর হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে বুৎপত্তি লাভ করে। এতে ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষার মান উন্নত হয়। ফলে আব্দুল হক মুহাদ্দিস-ই-দেহলভীর মতো পণ্ডিতলোক ভারতবর্ষের বুকে জন্মলাভ করেন। শুধু রাজধানী দিলি ও আগ্রায়। ইসলামি শাস্ত্র শিক্ষার মান উন্নত হয়।

 

 

 

 

সম্রাটদের বিদ্যানুরাগ: মুঘল সম্রাটগণ ছিলেন বিদ্যানুরাগী। আকবরের জন্মের পূর্ব থেকেই তাঁর পিতার দুরাবস্থা দেখা দেয়ায় তিনি বাল্যকালে নিজে বিদ্যা শিক্ষা করতে পারেন নি। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের বালাক তিনি একটি বিরাট গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইগারে এমন কোন পুনিককা করতেন। পাষানোর ভার কাছে বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে শুনাতেন। ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেন, গ্রন্থগারে এমন কোন পুস্তক ছিল না যা টিকে পড়েন নিভোগাঃ সম্রাট আকবর একটি অনুবাদ বিভাগ গঠন করেন। বিখ্যাত পণ্ডিতগণ এ বিভাগে নিযুক্ত থেকে। সম্রাটকে না।আরবি, সংস্কৃত, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষার বিখ্যাত পুস্তকসমূহ অনুবাদ করতেন।

বিবানিয়ার চোখে মুঘল শিক্ষাব্যবস্থা: ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ের মুঘল আমলের শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর তিনি মুঘল যুগে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব এবং ভূগোল, ইতিহাস রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াদির শিক্ষার সুযোগের অভাব অনুধাবন করেন। কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছাড়া ভারতবর্ষে প্রায় সকলেই ধর্মশাস্ত্র এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ভাষা শিখতে ব্যস্ত ছিল। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি কারো বিশেষ নজর ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মুঘল আমলে পাঠ্য তালিকায় ভূগোলের কোন স্থান ছিল না। ফলে শিক্ষিত ব্যক্তিরা ভৌগোলিক বিষয়সমূহে অজ্ঞ ছিল। আইন-ই-আকবরী ও খোলাসাত উত-তাওয়ারীখে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার বিবরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত ভৌগোলিক উপাদানের অভাব ছিল। মানচিত্র অঙ্কন ছিল না বললেই চলে।মুঘল আমলে জনশিক্ষার কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল না। সম্রাটরা পণ্ডিত ব্যক্তিগণকে লাখেরাজ সম্পত্তি বা বৃত্তি দান করতেন। তাঁরা মসজিদ বা মাদ্রাসা স্থাপন করে ছাত্রদেরকে শিক্ষা দিতেন। কিন্তু জনশিক্ষা ব্যাপকভিত্তিক করার জন্য বা বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় এ নিয়মে ও একই বিষয়াদি শিক্ষা দেয়ার জন্য বা শিক্ষার মান উন্নত করার উদ্দেশ্যে সরকার পরিচালিত কোন শিক্ষা বিভাগ ছিল না। শিক্ষার্থীদের জন্য কোন পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ তদারকি করার কোন নিয়ম ছিল না।

 

শিক্ষায় নারীরা: মুঘল শাসনকালে নারীরা বিদ্যাশিক্ষা করতে পারতো। এ সময়ে বিদুষী রাজকুমারী এবং স্ত্রীলোক সন্ন্যাসিনীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। হুমায়ুনের ভগিনি গুলবদন বেগম বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘হুমায়ুননামা’ লিখে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মুসলিম আমীর-ওমরাহগণ শিক্ষিতা স্ত্রী পছন্দ করতেন। আকবর মেয়ের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেছেন। আকবরের ধাত্রী মাতা মহান আনাগা নিজে একটি কলেজ স্থাপন করেন। আকবরের স্ত্রী সলিমা সুলতানা বেগম, মমতাজ মহল ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন।

 

গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা: মুসলমান উচ্চপদস্থ অফিসারগণ গ্রন্থাগার নির্মাণ করতেন। এসব গ্রন্থাগারে অনেক পুস্তক সংগ্রহ করে রাখা হতো। ফাদার মনসেরেটের মতে, আগ্রায় সরকারি গ্রন্থাগারে ২৪ হাজার মূল্যবান গ্রন্থ সংগৃহীত ছিল। তাঁর মতে এ গ্রন্থগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা।

 

সাহিত্য ও ইতিহাস: মুঘল শাসনকালে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের খুব বেশি উন্নয়ন না হলেও ধর্মীয় শিক্ষায় উন্নয়নের সাথে সাথে সাহিত্য ও ইতিহাস শাস্ত্রের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। মুঘল যুগে ঐতিহাসিক বাদাউনী, আবুল ফজল, ফিরিস্তা, কাফিখান, আব্দুল হামিদ লাহোরী, নিজামুদ্দীন আহমদ প্রমুখ ইতিহাস প্রণয়নে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। মুঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বাবর ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ও সুকবি। তিনি তুযুক-ই-বাংর লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মচরিত রচনা করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। হুমায়ুনের ভগ্নি গুলবদন বেগম রচিত হুমায়ুননামা, ফিরিস্তার তারিখ-ই-ফিরিস্তা, আবুল ফজলের আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী, নিজামুদ্দিনের তাবাকত-ই- আকবরী, আব্বাস শিরওয়ানীর তারিখ-ই-শেরশাহী প্রভৃতি গ্রন্থের ঐতিহাসিক মান ছিল অত্যন্ত উঁচু স্তরের। সাহিত্যে জাহানারা ও জেবুন্নেসা সে যুগে সুনাম অর্জন করেন। মুঘল যুগে কবি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন ফৈজী, রামদাস, সুরদাস, তুকারাম ও রামপ্রসাদ।

 

উপসংহার: উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুঘল আমলে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করে। তবে এ সময় ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসও চর্চা হতো। ইতিহাস রচনায় মুঘলরা ব্যাপক খ্যতি অর্জন করেছিল।