মুঘল যুগে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।

মুঘল যুগে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।

 

 

 

ভূমিকা: মুঘল আমল শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ উন্নতি লাভ করেছিল। গুজরাট মুসলমানদের অধিকারে আসায় ভারতবর্ষের মুসলমানরা সমুদ্রপথে আরব দেশে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং আরবদের সান্নিধ্যে এসে তারা ইসলামি হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে বুৎপত্তি লাভ করেনত। এতে ভারতবর্ষের ইসলামি শাস্ত্রের পড়াবনার মান উন্নত হয় এবং ফলে আব্দুল হক মুহাদ্দিস-ই দেহলভীর মতো পণ্ডিত লোক ভারতবর্ষের বুকে জন্মলাভ করেন।।

 

 

 

 

মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা: মুঘল আমলে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। শুধু এজধানী দিলিই নয়, বরং ভারতবর্ষের আরো কয়েকটি বিখ্যাত শহরে ইসলামি শাস্ত্র শিক্ষার মান উন্নত হয়। মুঘল সম্রাটরা বলেই বিদ্যার কদর করতেন আকবরের জন্মের পূর্ব থেকে পিতার দুরাবস্থা দেখা দেয়ায় তিনি নিজে বিদ্যাশিক্ষা করতে করেন নি। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন। তিনি একটি বিরাট গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। আকবর উপযুক্ত পণ্ডিতদের নিযুক্ত করতেন। পণ্ডিতরা নিজেরা তাদের বিভিন্ন পুস্তক পড়ে জেলাতেন। আবুল ফজল বলেন যে, গ্রন্থাগারে এমন কোন পুস্তক ছিল না যা সম্রাটকে পড়ে গুনানো হতো না। আখলাক-ই- রাসিয়ী, কিমিয়া-ই-সায়াদাত কাবুছমামা, শায়খ শরফ-উদ-দীন মানেরয়ীর লিখিত পড়ে সমূহ নেগুলিস্থন, হাকিম বিলাইর হারিকা, রমর মসনভী কাম-ই-জাম, বোস্তান, শাহনামা, নিজামীর মসনভী সমৃদ্ধি আছিসমূদর প্রিকুনজামীর এইগুলো, রাকানী এবং আন ওয়াবীর দিওয়ানসমূহ এবং বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থগুলো সম্রাট আকবরের বিশেষ প্রিয় ছিল। তাছাড়া গুগ্লাট আকবর একটি অনুবাদ বিভাগ গঠন করেন এবং বিখ্যাত পণ্ডিতরা এ বিভাগে নিযুক্ত থেকে আরবি, সংস্কৃতি এমনকি প্রাটিন ও গ্রিক ভাষার বিখ্যাত পুস্তকসমূহ অনুবাদ করতেন। ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ের মুঘল আমলের শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। বার্নিয়ের নিজে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক কালভার্টের শিষ্য ছিলেন এবং রেনেসাঁর পরবর্তী যুগে ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। তিনি মুঘল আমলে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ধরে দিতে পারেন এবং মুঘল যুগে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব এবং ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াদির শিক্ষার সুযোগের অভাব অনুধাবন করেন। এটি অবশ্যই সত্য যে, কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ছাড়া ভারতবর্ষে প্রায় সকলেই ধর্মশাস্ত্র এবং আরবি, ফার্সি বা সংস্কৃত ভাষা শিখতে ব্যস্ত ছিলেন। মুঘল আমলে বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের সময় শিক্ষার প্রসার হয় সত্য কিন্তু মুঘল শিক্ষা-ব্যবস্থা ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি কারো কোন বিশেষ নজর ছিল না। মুঘল আমলের পাঠ্য তালিকার ভূগোলের কোন স্থান ছিল না, ফলে শিক্ষিত ব্যক্তিরা ভৌগোলিক বিষয়সমূহে অজ্ঞ ছিলেন। আইন-ই-আকবরী বা খোলাসাত-উত-তওয়ারীখে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার বিবরণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ পুস্ত করয়েও বিজ্ঞানসম্মত ভৌগোলিক উপাদানের অভাব ছিল। তাছাড়া আইন-ই-আকবরী বা খোলাসাত-উত-তায়াতরীখের মতো আর কোন পুস্তক লেখা হয় নি, মুদ্রণযন্ত্রের অভাবে এ পুস্তকদ্বয়ের প্রচারও সীমাবদ্ধ ছিল। মানচিত্র অঙ্কন ছিল না বললেই চলে।

 

মুঘল আমলে জনশিক্ষার কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল না। মুঘল সরকার পণ্ডিত ব্যক্তিদেরকে লাখেরাজ সম্পত্তি বা বৃত্তি দান করতেন এবং এ সকল পণ্ডিতরা মক্তব বা মাদ্রাসা স্থাপন করে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। কিন্তু জনশিক্ষা ব্যাপকভিত্তিক করার জন্য বা বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় একই নিয়মে ও একই বিষয়াদি শিক্ষা দেয়ার জন্য বা শিক্ষার মান উন্নত রাখার উদ্দেশ্যে সরকার পরিচালিত কোন শিক্ষা বিভাগ ছিল না। ছাত্রদের জন্য কোন পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বা শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ তদারক করার কোন নিয়ম ছিল না। মুঘল আমলে স্ত্রী-পুরুষ সকলে বিদ্যাশিক্ষা করতে পারে, এ বিষয়ে বিদুষী রাজকুমারী এবং স্ত্রীলোক সন্ন্যাসিনীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম আমির-ওমরাহেরা শিক্ষিতা স্ত্রী পছন্দ করতেন। আকবর বালিকাদের শিক্ষার জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেন। আকবরের ধাত্রীমাতা মাহাম আনাগা নিজে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। আকবরের মহিষী সলিমা সুলতানা বেগম, শাহজাহান পত্নী সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখতেন। মুসলমান মেয়েরা পর্দা প্রথা মেনে চললেও তারা শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। সুলতানি আমলের সুলতানা রাজিয়ার কথা বলা যেতে পারে। মুঘল আমলে চাঁদ সুলতানা আহমদ নগরের শাসন-পরিচালনা করেন, সম্রান্ত্রী নূরজাহান স্বামীর পক্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। মুসলমান উচ্চপদস্থ অফিসারগণ গ্রন্থাগার নির্মাণ করতেন এবং এ সকল গ্রন্থাগারে সর্বদা অনেক পুস্তক সংগ্রহ করে রাখা হতো। মুদ্রণযন্ত্র না থাকলেও মুঘল আমলে প্রায় অনেক বড় বড় শহরে অনেক নকলনবীশ পাওয়া যেত এবং তারা পুস্তক নকল করে প্রচুর আয় করতেন।

 

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, মুঘল আমলে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণের প্রধান কেন্দ্র ছিল মক্তব। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিম ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। ফলে তারা প্রশাসনিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতো। তাছাড়া মুঘল শাসকগণও মুসলিম শিক্ষার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। যা মুসলিম শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে একথা বলা যায়।