ব্রিটিশদের দেওয়ানি আদালত সম্পর্কে বর্ণনা কর।
ভূমিকা: ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসনের সময় ওয়ারেন হেস্টিংসের মাধ্যমে দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজস্ব ছাড়াও ভূমি সংক্রান্ত সকল মামলার বিচারের ভার এ আদালতের উপর ন্যস্ত করা হয়। কর্ণওয়ালিসের সময় এ আদালতের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পায়। সমগ্র দেওয়ানি আদালতের সর্বোচ্চ ছিল সদর দেওয়ানি আদালত। গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলে বিচারালয়ের বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। ঢাকা, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় প্রাদেশিক চারটি দেওয়ানি আদালত স্থাপিত হয় এবং প্রত্যেক জেলায় একটি করে দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দেওয়ানি আদালত সম্পর্কে আলোচনা: দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাকোর নারঞ্জীত করার জন্য কেন্দ্র, প্রদেশ ও জেলায় একে বিভক্ত করেন। নিম্নে দেওয়ানি আদালত সম্পর্কে অবিচারব্যবস্থাকে সুনিয়
১. কালেক্টর নিয়োগ: রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলার বহনেক জেলায় দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। হেস্টিংসের সময় এ আদালত মফস্বল দেওয়ানি আদালত নামে পরিচিত ছিল। এ আদালতে কালেক্টর নিয়োগ করা হয়। যিনি মফস্বল দেওয়ানি আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন, তিনি জমিদার আম মামলার বিচার ব্যতীত শুধু ভূমিবিষয়ক মামলার বিচার করতেন। চিরস্থায়ী বমোবন্তের পর জেলা দে ওয়ানি আদালত থেকে তালুকদারির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কালেক্টর পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং এর পরিবর্তে প্রতি জেলায় একজন জজ নিযুক্ত করা হয়। কালেক্টরের অধীনে মাল আদালত বা রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে সমস্ত রাজস্ব বিচার জেলা জজের আত্ততাভুক্ত করা হয়।
২. জেলাসমূহকে চারটি বিভাগে বিভক্ত: দেওয়ানি বিচার শাসনের সুবিধার্থে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা ও পাটনায় বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক বিভাগের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় তিন জন জজ বিশিষ্ট একটি প্রাদেশিক আপিল আদালতের। জেলা ও শহর দেওয়ানি আদালতের সব মামলার ডিক্রি প্রাদেশিক আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়। পূর্বে শুধু এক হাজার টাকার ঊর্ধ্ব মূল্যের দেওয়ানি মামলা উচ্চ আদালতে আপিলযোগ্য ছিল। এ বাধা বিলুপ্ত করে এখন যে কোন মূল্যের মামলা জেলা আদালত থেকে প্রাদেশিক আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়।
৩. ভূমি রাজস্বের নিশ্চয়তা ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান: ভূমি রাজস্বের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান ছিল কর্নওয়ালিসের সিস্টেমের অন্যতম উদ্দেশ্য। দেওয়ানি আদালতের প্রথার সুযোগ নিয়ে জমিদারগণ যেন সরকারি রাজস্ব নিয়ে কারসাজি না করতে পারে সেজন্য কালেক্টর কর্তৃক ভূমি রাজস্ব সংগ্রহকে নতুন দেওয়ানি আদালত প্রথার বহির্ভূত রাখা হয়।
৪. প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন নিষিদ্ধ দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠার পূর্বে বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের দৈহিকভাবে নির্যাতন করতো রাজস্ব কর্মচারীরা। কিন্তু দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠার পরে দৈহিকভাবে নির্যাতন বা বলপ্রয়োগের আশ্রয় না নিয়ে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়।
৫. হিন্দু ও মুসলমান আইন অফিসার নিয়োগ: দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেওয়ানি আদালত বিচার পরিচালনা করবে। ইউরোপীয় বিচারককে হিন্দু ও মুসলিম বিষয়ে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক দেওয়ানি আদালতে একজন হিন্দু ও একজন মুসলমান আইন অফিসার নিয়োগ করা হয়।
৬. রাজস্ব ব্যবস্থাকে পৃথক করা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে রাজস্ব দেওয়ানির সাথে দেওয়ানি মামলার বিচার জড়িত ছিল। ফলে রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের সাথে সাথে কর্নওয়ালিস দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাকে রাজস্ব ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেন।
দেওয়ানি আদালতের গুরুত্ব বা তাৎপর্য: দেওয়ানি আদালত ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. দেওয়ানি আদালতেরমাধ্যমে ভূমি রাজস্বের নিরাপত্তার বিধান করা হয়েছে। এখানে জমিদারগণ কোন প্রকার কারসাজির আশ্রয় নিতে পারবে না।
২. পূর্বে শুধু এক হাজার ঊর্ধ্ব মূল্যের মামলা সদর দেওয়ানি আদালতে আপিলযোগ্য ছিল, কিন্তু এটি বিলুপ্ত করে যে কোন মূল্যের মামলা জেলা থেকে প্রাদেশিক আদালতে আপিলযোগ্য করা হয়।
৩. এ আদালতের মাধ্যমে বকেয়া খাজনার ক্ষেত্রে প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয় এবং আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করার কথা বলা হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে রাজস্ব সমস্যার সমাধান করা ছাড়াও ভূমি সংক্রান্ত সকল সমস্যার অবসান ঘটানো, এর মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিকে মজবুত করে তোলা হয়, যা ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে।