ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব বর্ণনা কর।

 

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব বর্ণনা কর।

ভূমিকা: বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মুঘল আমলে বাণিজ্যের সূত্র ধরে ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসে এবং ধীরে ধীরে তারা বাংলায়ও বাণিজ্য বিস্তার করে। কালক্রমে এদেশের পরিস্থিতি তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনে প্রলুব্ধ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইরেজরা পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলায় তাদের একটা শক্ত স্থান গড়ে তোলে। তবে ১৭৬৫ সালের দিউয়ানি লাভের পরে বাংলা তথা ভারতে সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করে এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল কুশাসন, শোষণ এবং অত্যাচার যা সহ্য করতে হয়েছে বাংলা তথা ভারতকে। তারা মাঝে মাঝে কিছু ভালো কাজ করেছে যা ভারতীয় উপমহাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

 

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব: ভারতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচকের কাজগুলো বেশি সম্পন্ন হয়েছিল। অর্থাৎ ভারতবর্ষের জনগণ সবক্ষেত্রে ব্রিটিশ কর্মচারী কর্তৃক শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত হয়েছে। নিম্নে

 

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:

 

১. অর্থনীতিকে পঙ্গু করা: ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীন ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা, ভূমির মালিকানা স্বত্ব প্রদান, কর আদায় ও কর ধার্যের নতুন রীতিনীতি জনগণের অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। জোরপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করা ও খাজনা আদায়ে অমানুষিক জবরদস্তিমূলক আচরণ কৃষককুলকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে। ইংরেজদের কার্যকলাপে দেশীয় হস্তশিল্প ও কলকারখানা ধ্বংস হয়। এ জায়গায় ব্রিটিশ শিল্পসামগ্রী ও পণ্য ভারত বাংলার বাজার পুরোপুরি দখল করে।

 

২. সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হারাতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা ছিল আরো করুন। ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু জনগণের মধ্যে ধীরে ধীরে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটলেও মুসলমানরা এক্ষেত্রে পিছিয়েছে।

 

৩. হিন্দু-মুসলিম বৈরী মনোভাব সৃষ্টি: শাসন ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য ইংরেজ সরকার হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে এবং মুসলমানদের পরিবর্তে হিন্দুদের তোষণনীতি চালু করে। ফলে সমাজজীবন ব্যবস্থায় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বৈরী মনোভাব সৃষ্টি হয়।

 

৪. মুসলিম সংস্কার আন্দোলন: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে বাংলার ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ সময় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আলীগড় ও ফরায়েজী আন্দোলন এর প্রকৃত উদাহরণ। পাশ্চাত্য ভাবধারা হতে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ এসব সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। এদের মধ্যে শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হাজী শরীয়তউল্লাহ, সৈয়দ আহমদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

 

 

৫. ইংরেজি শিক্ষার প্রাতাব: ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে এদেশে সীমাবদ্ধ হলেও যে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন করে তা ভারতেরযোজনার এই কর হয়। কারণ এরা লক, মিল, রুশো, ভলটেয়ারশ সীমাবদ্ধ হলোও প্রমুখ চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযেফায় শিক্ষিতইরে। ইংরেজি শিক্ষা এ দেশের সম্রাটেয়ার, কোজার ও বার্ক প্রমুখ চিন্তাধারার হন্দু সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি ও ব্যবসায় বাগঞ্জ ও সংস্কৃতি অনেকখানি বদলে দেয়ংরেজিরাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। বিমা বাংলার মুসলমানেরা পাশ্চাত্য জানিতে জায়গা করে নেয়। পরবর্তীতে ইংরেজি বৃষ্ট্রে ভাষার থাকে। ফলে তারা সামাজিক দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ে। অন্ধ বিনোট কথা ইংরেজি ভাষা শিক্ষালাভ করা থেকে শ্রিণির গোঁড়া মুসলমানের প্রচার প্ররোচনাও দায়ী ছিল।

 

৬. অভিন্ন আইনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন: ব্রিটিশরা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সমগ্র ভারতের একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। অভিন্ন আইনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়। এর ফলে দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়, তা মুঘল সম্রাটদের আমলেও ছিল না। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এ. আর. দেশাই বলেছেন, “ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম উলেখযোগ্য ফল হলো এমন একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম দেশের মধ্যে প্রকৃত ও মৌলিক ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করেছে।” একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকার ফলে দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐক্য বৃদ্ধি পায়। ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশের পথ সুগম হয়।

৭. কৃষক আন্দোলন সংঘটিত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এদের কাজ ছিল প্রজাপীড়ন এবং ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সুবিধা অর্জন। এজন্যই বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ছোট বড় মিলিয়ে অনেক কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়।

 

৮. জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের জন্ম: ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের আশায় বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে উঠে। কিন্তু সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এসব আন্দোলন সফল হতে পারে নি। তাই ১৮৮৫ সালে ‘সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এর জন্ম হয়। এ দেশের জনগণের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। তাই ১৯০৬ সালে ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’ নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন জন্ম লাভ করে।

৯ : নিজেদের সংকীর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্রিটিশ সরকার ভারতে সীমাবদ্ধ পুঁজিতন্ত্রের প্রবর্তন করে।পুঁজি বিনিয়োগ এখানে পুঁজিপতিরা ব্যাংক, বিমা ইত্যাদিতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকে। পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ভারতীয় পুঁজিপতি যাতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য তারা সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করে। কিন্তু ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা পুঁজিবাদ বিকাশের সাধারণ প্রক্রিয়াটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন নি। তাই বিদেশি পুঁজির সাথে সাথে তাদের কিছু পরিমাণে দেশীয় পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হয়। দেশীয় পুঁজিপতিরাই হলো ভারতের বুর্জোয়াশ্রেণির পূর্বসূরি। এ দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে ব্রিটিশ পুঁজিপতি শ্রেণিরা পরাস্ত হয়।

 

১০. সচেতন বৃদ্ধি: দীর্ঘ দু’শত বছরের ব্রিটিশ শাসন অবিভক্ত বাংলার জনগণকে পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করতে সহায়তা করে। বাংলার জনগোষ্ঠী পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক জীবনের সংস্পর্শে আসে। যার ফলে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণ ধীরে ধীরে সচেতন হতে শুরু করে।

 

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা হতে পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘ দু’শত বছরের ব্রিটিশ শাসনে বাংলা তথা ভারতবর্ষে শুধু শোষণ আর নিপীড়নের মাত্রা থাকলেও তারা কিছু ইতিবাচক কাজ করে। অবশ্য ইতিবাচক কাজ ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন, আইনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাংক ও বিমায় পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি নিজেদের স্বার্থে প্রয়োগ করে। কিন্তু এর মাধ্যমে ভারতীয় জনগণ শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এদের মধ্য থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এসব সচেতন ব্যক্তি ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্য থেকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরাই ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান তথা যবনিকা ঘটায়।