মুঘলদের আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকা: মুঘল আমলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় শাসনের পাশাপাশি প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা খুবই কার্যকরী ছিল। মুঘল শাসকদের মধ্যে সম্রাট আকবর প্রদেশ শাসনের সুন্দর ব্যবস্থা প্রচলন করেছিলেন। তিনি শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। প্রদেশের শাসন সম্পূর্ণরূপে সম্রাটদের টদের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন ছিল। কেন্দ্রীয় ও প্রদেশ শাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন সম্রাট। প্রাদেশিক কর্মচারীদের অনুরূপ কর্মচারী কেন্দ্রীয় শাসনে বিদ্যমান ছিল। প্রদেশের বিভাগীয় কর্মচারীগণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিকট তাঁর কাজের জন্য দায়ী ছিল। সম্রাট আকবর যে প্রদেশ শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন তাহা সমগ্র মুঘল আমলে প্রচলিত ছিল।
মুঘল আমলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা: মুঘল আমলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করতে এবং সুবাদার যেন স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য কিছু নীতি অবলম্বন করেন। যেমন- প্রদেশ শাসনকে কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক কর্মচারীর ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য লিখিতভাবে নির্দিষ্ট করে দেন। একজন বিভাগীয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী অন্য বিভাগের প্রধান কর্মচারীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতেন। নিম্নে মুঘল আমলে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সুবাদার: সুবাদার ছিলেন সর্বোচ্চ প্রাদেশিক শাসনকর্তা। তিনি ‘নাজিম’ এবং সিপাহসালার নামে অভিহিত হতেন। সুবাদার, কেন্দ্রীয় উজির বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। প্রধানমন্ত্রী সুবাদারের শাসনকার্য তত্ত্বাবধান করতেন। সুবাদার তাঁর দায়িত্বের জন্য সম্রাটের নিকট দায়ী থাকতেন। প্রদেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিদ্রোহ দমন করা, সম্রাটের আদেশ নির্দেশ কার্যকরী করা এবং প্রাদেশিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সুবাদার এ সবের দায়িত্বে থাকতেন। সুবাদারকে প্রধানত চার-পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ করা হতো। মেয়াদ শেষ হলে অন্যকোন আমিরকে সুবাদারের পরিবর্তে নিয়োগ করতেন। তিনি প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক থাকতেন। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি স্থাপন ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারতেন না। সুবাদার যতদিন পর্যন্ত সম্রাটের অনুগত থাকতেন, ততদিন তিনি নিজের প্রদেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করতেন এবং কর্মচারীরা বিনা প্রতিবাদে তাঁর নির্দেশ মেনে চলতেন।
২. দিউয়ান: প্রত্যেক গ্রদেশে একজন করে দিউয়ান নিযুক্ত হতেন। সাম্রাজ্যের প্রধান দিউয়ানের পরামর্শে সম্রাট প্রাদেশিক দিউয়ান নিয়োগ করতেন। প্রধান দিউয়ান প্রাদেশিক দিউয়ানের কাজের তত্ত্বাবধান করতেন এবং তাকে আদেশ নির্দেশ দিতেন। প্রদেশের অর্থের দায়িত্বে প্রাদেশিক দিউয়ানের উপর ন্যস্ত ছিল। রাজস্বের আয়-ব্যয়, হিসাব-নিকাশ এবং রাজস্ব ব্যবস্থার সুবন্দোবস্ত করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। তাঁর অনুমোদন ব্যতীত সুবাদার প্রদেশের রাজকোষ হতে টাকা ব্যয় করতে পারে না এবং টাকার জন্য সুবাদারকে দিউয়ানের মুখাপেক্ষী হতে হতো। রাজস্ব ও অর্থ সংক্রান্ত নতুন কর্মচারী নিয়োগ ও বরখাস্তের সকল ব্যাপার তাঁর এখতিয়ারভুক্ত ছিল। তিনি রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা মকদ্দমার নিষ্পত্তি করতেন।সুবাদারের সঙ্গে দিউয়ানের মতান্তর ঘটলে সম্রাট এর সমাধান দিতেন।
৩. বকশী: প্রদেশের সামরিক বিভাগের কার্য পরিচালনার জন্য একজন বকশী নিযুক্ত হতো। প্রাদেশিক বকশীকে কেন্দ্রীয়মীর বকশীর পরামর্শে নিয়োগ করা হতো। বকশী তাঁর কার্যের জন্য মীর বকশীর নিকট দায়ী থাকে। তিনি প্রদেশের মনসবদারের অধীনস্থ সৈন্যদের প্রশিক্ষণ, নিয়মানুবর্তিতা ও যোগ্যতার তত্ত্বাবধান করেন। তিনি এদের প্রশিক্ষা সম্বন্ধে সন্তুষ্ট না হলে সৈন্য ও মনসবদারদের বেতন বন্ধ করতে পারেন। তিনি প্রদেশের সামরিক ব্যাপারে সুবাদারকে পরামর্শ দিতেন এবং প্রয়োজনমত অভিযানের ব্যবস্থা করতেন। সামরিক দায়িত্ব ছাড়াও ওয়াকিয়ানবিসের (সংবাদ সরবরাহকারী) কাজ করতেন।
৪. সদর: প্রাদেশিক সদর কেন্দ্রীয় সদর-ই-সুদূরের পরামর্শে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। সদর তাঁর কাজের জন্য প্রধান সদরের নিকট দায়ী থাকেন। তিনি প্রদেশের ধর্মীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধান করেন। প্রদেশে কাজি না থাকলে তিনি বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁর সুপারিশক্রমে ধার্মিক, শিক্ষিত, এতিম প্রভৃতি লোকদেরকে এবং ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষ্কর জমি ও অন্যান্য প্রকারের সাহায্য দেয়া হতো।
৫. মীর বহর: প্রদেশের নৌবাহিনীর প্রধানকে মীর বহর বলা হতো। তিনি সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। তিনি প্রয়োজনে সুবাদার ও বখশীকে তাঁর নৌশক্তি দিয়ে সাহায্য করেন। স্বীয় কর্মক্ষেত্রে মীর বহরের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ছিল।
৬. মুহতাসিব: রাজধানী শহরের লোকের ধর্মীয় চরিত্র ও নৈতিক জীবন তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন মুহতাসিব নিয়োগ করা হতো। লোকের ধর্মকর্মে শিথিলতা ও নৈতিক জীবনে অধোগতি দেখা দিলে মুহতাসিব যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রয়োজনবোধে তিনি শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। সমাজের কলুষতা দূর করে ধর্মভাব ও নীতিবোধ সমাজজীবনে রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব ছিল।
৭. কোতোয়াল: অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্য রাজধানী শহরে একজন কোতোয়াল বা নগরপাল নিয়োগ করা হতো। তিনি সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। কোতোয়াল প্রদেশে সুবাদ শহরে এবাজেন কোতোয়ালান দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি শহরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষণ, দুর্বৃত্ত দমন এবং অপহৃত দ্রব্য উদ্ধার কোতোয়ালের দায়িত্বে ছিল।
৮. ওয়াকিয়ানবিস বা সংবাদ প্রেরণকারী: ওয়াকিয়ানবিস নামে প্রাদেশিক কর্মকর্তা সমস্ত ঘটনার বিবরণ কেন্দ্রে প্রেরণ করেন। তিনি প্রদেশ সম্পর্কে সমস্ত বিষয় সম্রাটকে অবহিত করতে লালে
৯. সরকার ও পরগনা: প্রদেশগুলো কয়েকটি সরকারে বিভক্ত ছিল। সরকারের শাসনভারের দায়িত্ব ছিল ফৌজদারের উপর। ফৌজদার সেনা দিয়ে সুবাদারকে সাহায্য করতেন। সরকারগুলো পরগনায় বিভক্ত করা হতো। পরগনার প্রধান কর্মচারী ছিলেন আমিল। তাকে অনেক ক্ষেত্রে শিকদার ও আমল করায় নামেও অভিহিত করা হতো। তিনি কেন্দ্রীয় দিউয়ানের পরামর্শক্রমে সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। পরগনার রাজার শাসননাশোন্তিরক্ষী তাঁর দায়িত্ব ছিল। আমিল রাজস্ববিষয়ক আইনকানুন ও বিধিব্যবস্থা কার্যকরী করতেন এবং পরগনার খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করতেন। আমিলের কাজে সাহায্য করার জন্য পরগনায় আরও কয়েকজন কর্মচারী ছিল। এদের মধ্যে আমীন, কারকুন, খাজাঞ্চি ও কানুনগো উলেখযোগ্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাদেশিক শাসন শক্তিশালী হওয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসন শক্তিশালী হতো। এর জন্য প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক বিভাগে যোগ্য কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হতো। প্রত্যেক কর্মচারী তাঁদের নিজ নিজ বিভাগে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন, যা প্রাদেশিক শাসনকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। আর প্রাদেশিক শক্তিশালী শাসনব্যবস্থাই ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সম্রাটদের কর্তৃত্বকে সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি করে।