ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা এ দেশে চালু করার প্রয়োজন কী ছিল?

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা এ দেশে চালু করার প্রয়োজন কী ছিল?

 

 

ভূমিকা: বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ব্রিটিশরা বাণিজ্য করার নামে রাজস্ব দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ ও দিউয়ানী লাভের মধ্য দিয়ে সর্বময় ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের প্রচুর ধনরত্ন আত্মসাৎ করে ইংল্যান্ডে পাচার করা। এসব সম্পদ দিয়ে নতুন দ্রব্য তৈরি করে ভারতে ব্রিটিশদের বাজার তৈরি এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা।

 

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা এদেশে চালু করার প্রয়োজনীয়তা: ব্রিটিশরা এদেশে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। নিম্নে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা এদেশে চালু করার প্রয়োজনগুলো আলোচনা করা হলো:

 

১. রাজনৈতিক স্বার্থ: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হয়েছিল। তাঁরা এর মাধ্যমে পুরো ভারতকে ধীরে ধীরে দখল করে। সমস্ত ভারতে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ লোকদের নিযুক্ত করে। ফলে ভারতে তাঁরা কর্তৃত্ব স্থাপন করার মধ্য দিয়ে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এছাড়াও ভারতের গভর্নর জেনারেলরা বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন এবং নিজস্ব নীতিগুলো চালুর মাধ্যমে শোষণভিত্তিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি করে এবং তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে।

 

২. অর্থনৈতিক শোষণ: ভারতবর্ষকে কাঁচামাল উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতো। এজন্য বাণিজ্য ফসল যেমন- নীল, পাট, চা এবং শিল্প হিসেবে খনিশিল্প, পাটজাত সামগ্রী প্রস্তুত শিল্প প্রভৃতি গঠনের দিকে ইংরেজগণ ‘মনোনিবেশ করে। এজন্য তাঁরা এদেশের কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা ও খাজনা আদায়ে অমানুষিক জবরদস্তিমূলক আচরণ কৃষককুলকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলে। এসব উৎপাদনে ইংরেজ বণিক সম্প্রদায় অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা লুটের ব্যবস্থা করে। এছাড়া ইংরেজরা দেশীয় শিল্প ও কলকারখানা ধ্বংস করে। এর পরিবর্তে ব্রিটিশ শিল্পসামগ্রী ও পণ্য পুরোপুরি বাংলার বাজার দখল করে। এভাবে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় শিল্প ও বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে।

 

৩. ঔপনিবেশিক শিল্পনীতি: ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শিল্পনীতি ছিল উপনিবেশগুলোকে কাঁচামাল উৎপাদন কেন্দ্র বানাত। আর সেই কাঁচামাল নিজ দেশে চালান দিয়ে তাঁরা দ্রব্য তৈরি করে সেই দ্রব্য আবার উপনিবেশে রপ্তানি করে। ভারতবর্ষের ব্যাপারেও এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

 

. ধর্মের প্রচার: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রিটিশ মিশনারিরা ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার চালায়। মিশনারীরা খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারের জন্য তাঁরা বাইবেলের অনুবাদ, টীকা দেশীয় ভাষায় অনুবাদ করত। এজন্য তাঁদের গদ্য সাহিত্যের প্রয়োজন ছিল। এ প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে মিশনারিরা ব্যাকরণ ও শব্দযোজনা প্রভৃতি সম্পর্কে পুস্তক ভারতীয় ভাষায় রচনা করেন। এভাবে তারা ভারতবর্ষের জনগণকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেন।

 

 

 

সুসভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তোলা: সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ভারতকে নিজেদের উপনিবেশ হিসেবে রাখার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করে। এখানে বলা হয় যে, অলভ্য ও বর্ণর ভারতীয়দের সুসভ্য ও শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পবিত্র দায়িত্ব তাদেরই। কারণ তারা হলো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিগ ভারতীয়দের ভাসেক জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে ইংরেজরা ঐতিহ্যমণ্ডিত সুপ্রাচীন হিন্দুসভ্যতা, সংস্কৃতি অতিপ্রতিইভাবে নিজেদের জাতিয়ার শেষ করতো। কারণ তারা ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যে কেবলমাত্র বিদ্রোহ, হত্যা ও বর্বরোচিত বিষয় ছাড়া কিছুই দেখতে পাননি। তাই এহেন বর্বর গত্যতাকে ধ্বংস করে তার জায়গায় সুসভ্য ব্রিটিশ সভ্যতার বুনিয়াদ নির্মাণের জন্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বিশেষভাবে চেষ্টা করে এবং এর জন্যই তারা ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।

 

৬. রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানিকে শক্তিশালী করা: ব্রিটিশরা রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শক্তিশালী করে। এজন্য তারা পঞ্চসনা বন্দোবস্ত, দশসালা বন্দোবস্ত এবং সবশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু করে। ব্রিটিশরা ভারতে পঞ্চসালা ও দশসালা বন্দোবস্তের সময় জমিদার ও প্রজাদের উপর রাজস্ব তথা কর আরোপ নিয়ে পরীক্ষা চালায়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে। যার মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি বা কমবে না। রাজস্ব যা ছিল তাই থাকবে। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ কোম্পানি অত্যন্ত লাভবান হয়। ৭. ঔপনিবেশিক শক্তি

 

বৃদ্ধি: ব্রিটিশরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। আর এজন্য এ শক্তিকে বৃদ্ধির জন্য তারা ভারতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতবর্ষকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। এভাবে ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপন, আমেরিকায় কর্তৃত্ব স্থাপন এবং আফ্রিকায় কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়।

 

গুরুত্ব: ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা এদেশে চালু করার প্রয়োজন ছিল কারণ তাদের নিজেদের স্বার্থে। যেমন- রাজনৈতিক স্বার্থে, অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী করা। এছাড়াও এদেশে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার করা, ভারতে ব্রিটিশ বাজার তৈরি করা, শুল্কবিহীন বাণিজ্য করা এবং ঔপনিবেশিক শক্তি বৃদ্ধি করা।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এদেশ শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এদেশের প্রচুর ধনসম্পদ ব্রিটিশরা নিয়ে যায়। এদেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে, রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে, হিন্দু-মুসলমান বৈষম্য সৃষ্টি করে। এক কথায় বলা যায়, ব্রিটিশরা দু’শত বছর এদেশে শুধু শোষণই করেছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন উন্নয়ন করে নি।