উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবনতি ঘটে কেন?

 

 

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবনতি ঘটে কেন?

ভূমিকা: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের বিপর্যয় নেমে আসেম শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমান হিন্দুদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। প্রতিটি ঘটনা। বা অবস্থার পিছনে লুকিয়ে থাকে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ। তাই উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অবনতিরও কতিপয় কারণ রয়েছেগুলো সুনিদিষ্ট বই প্রশ্নের আলোচ্য বিষয়।

ইউনিশ শতকে শিক্ষাক্ষেত্রে খুব পিছিয়ে পড়ে। এডামের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৩৮ সালে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, শাসনামলে মুসলমানগণ বিহারে আরবি ফার্সি বিদ্যালয়গুলোতে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা ছিল ২০৯৬ জব স্থাবং মুসলিম ছাত্রের সংখান লি২৫১৫ জন।” এডামের রিপোর্ট অনুযায়ী আরবি ফার্সি বিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রের অবস্থান এতটা শোচনীয় সংখ্যা ছিল ১৫১৫ জননাতে তাদের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা অনুধাবন করা যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অবনতির পিছনে যে কারণগুলো বিদ্যমান ছিল সেগুলো নিম্নরূপ:

 

১. গ্রামের মুসলমানদের প্রতি সরকারের উদাসীনতা: মুসলমানদের অধিকাংশই গ্রামে বাস করতো। তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। এডাম উপলব্ধি করেন যে, গ্রামাঞ্চলে মুসলমানদের শিক্ষার জন্য সরকারি সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন। ছিল। কিন্তু সরকার গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। সরকারি গ্রামের এ সকল মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার প্রতি উদাসীন ছিল।

 

২. নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত ও দান সম্পত্তির অপব্যবহার: কোম্পানির শাসকগণ নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত করেন এবং মুসলমানদের প্রতিষ্ঠানগুলোর দান সম্পত্তির অপব্যবহার করেন। অর্থাৎ এ সম্পত্তি সরকার অন্য কাজে ব্যবহার করেন। ।সরকারের এ নীতির সমালোচনা করেন

৩. মুহসিন ফান্ডের অর্থ অন্য কাজে ব্যয়: সরকার হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের ওয়াকফ সম্পত্তি আসল উদ্দেশ্যে এডাম ব্যবহার না করে অন্যভাবে ব্যবহার করছিল। ১৮০৬ সালে ধর্মপ্রাণ মুহসিন তাঁর বিশাল সম্পত্তি উইল করে মুসলমানদের অবহেলিত ও শিক্ষায় অনগ্রসর চাত্রচাত্রীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য দান করে যান। ১৮৩১ সালে মুহসিন ফান্ডে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ছিল। সরকার ইমামরাজ ও একজন মুতওয়ালীর জন্য ব্যয় বরাদ্দ করে অবশিষ্ট অর্থ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে এর সুদ হতে যা আয় হতো তা শিক্ষা কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে। মুহসিন ফাণ্ডের টাকা দিকে হুগলিতে একটি কলেজ স্থাপন কারার প্রস্তাব দেয়া হয়। কলেজ স্থাপনের কাজে ১,৪০,০০০ টাকা ব্যয় মঞ্জুর হয়। বার্ষিক ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ হয় ৫৪,০০০ টাকা। হুগলি কলেজে ছাত্রদের নিজ অর্থায়নে লেখা পড়ার কথা বলা হলে মুসলি ছাত্রদের জন্য তা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় মুহসিন ফান্ডের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হুগলি কলেজ দ্বারা মুসলমানরা তেমন উপকৃত হতে পারে নি। সরকার কর্তৃক মুহসিন ফাণ্ডের অপব্যবহারের সমালোচনা করে হান্টার বলেন, “এ আত্মসাতের অভিযোগ সম্বন্ধে আলোচনা বড়ই কষ্টদায়ক। কারণ এ অভিযোগ অগ্রাহ্য করা অসম্ভব”। ১৮৪০ সালে সরকার এ ফান্ডের টাকা এবং দান সম্পত্তির বার্ষিক আয় একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য বরাদ্দ করে। যদিও ভূসম্পত্তি মুসলমানদের শিক্ষার জন্য করা হয়েছিল। তবু এ বিদ্যালয়ে দরিদ্র মুসলমানগণ শিক্ষার ব্যাপারে কোন আর্থিক সুবিধা পায় নি।

৪. অনুপযুক্ত ইংরেজি শিক্ষা: কলেজে ও স্কুলের ইংরেজি শিক্ষা মুসলমানদের উপযোগী ছিল না। কলকাতা মাদ্রাসায় যোগ্য ইংরেজি শিক্ষকের অভাব ছিল। ১৮৫০-৫১ সালের একটি তদন্ত রিপোর্ট হতে জানা যায় যে, কলকাতা মাদ্রাসার ৯০ জন ইংরেজি ছাত্রের জন্য মাত্র একজন ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি বর্ণমালা হতে শুরু করে গোল্ড স্মিথ, ওয়াটস, ইউক্লিড প্রভৃতি বিষয় পড়াতেন। যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

৫. মুসলমানদের মনঃপুত শিক্ষাব্যবস্থার অভাব: স্কুল ও কলেজগুলোতে আরবি ও ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। মিশনারি স্কুল ও কলেজগুলোর পাঠ্যতালিকা মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য হয় নি। হিন্দুদের পরিচালিত স্কুল কলেজে মুসলমানদের ভর্তির সুযোগ খুব কম ছিল। বাংলা পাঠশালাগুলোর পাঠ্য তালিকা মুসলমানদের শিক্ষার উপযোগী না হওয়ায় তারা সেখানে ভর্তি হতে উৎসাহ দেখাত না। বিদ্যালয়গুলোতে যে সংস্কৃত উদ্ভূত বাংলা শিক্ষা দেয়া হতো তা মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়তো। কারণ তারা কথ্যভাষা ব্যবহার করতো। তাছাড়া বাংলা পাঠ্যপুস্তক দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনীতে পূর্ণ ছিল।

৬. দারিদ্র্যতা : তৎকালীন সময়ে মুসলমানরা ছিল হিন্দুদের তুলনায় দরিদ্র। ফলে শিক্ষার জন্য তারা খুব একটা অর্থ খরচ করতে পারতো না। ফলে তারা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।

 

৭. ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা: মুসলমানরা যখন তাদের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং ইংরজরা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে তখন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজদের ঘৃণা করতে থাকে। ফলে তারা ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে মুসলমানরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।

 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ইংরেজ তথা কোম্পানির সরকারের শিক্ষানীতি ছিল পক্ষপাতদুষ্ট তাদের শিক্ষানীতি ছিল ইংরেজদের অনুকূলে এবং মুসলমানদের প্রতিকূলে। ফলে বিরোধিতার মুখে টিকতে না পেরে উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।