বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর।
ভূমিকা: বাংলার তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শক্তি বাংলায় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলা হতে দিলি পর্যন্ত আর কোন শক্তিই ইংরেজদের প্রতিরোধ করার মতো ছিল না।
বক্সারের যুদ্ধের কারণ: নিম্নে বক্সারের যুদ্ধের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. চুক্তির বিপরীত: মীরজাফরের অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা এবং ইংরেজদেরকে প্রতিশ্রুত অর্থ আদায়ের অক্ষমতায় বিরক্ত হয়ে ইংরেজ কোম্পানি তাকে অপসারিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতা প্রেসিডেন্সির গভর্নর ভ্যান্সিটাট ও মীর কাসিমের মধ্যে গোপন শলাপরামর্শের মাধ্যমে একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত মোতাবেক মীরজাফর নামমাত্র নবাব থাকবেন এবং মীর কাসিম নায়েব সুবাদার হবেন। শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তার বিপরীত। ফলে মীর কাসিমের উপর ইংরেজরা তখন থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। 1
২. ফরমানের অবমাননা: ১৬৫৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক চুক্তি অনুযায়ী সুবে বাংলা সরকারকে বাৎসরিক ৩ হাজার টাকা দেবার বিনিময়ে শতকরা আড়াই ভাগ চিরাচরিত বাণিজ্য শুল্ক হতে মুক্তি পায়। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও এর কর্মচারীরা কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে এ দস্তকের অপব্যবহার করে। ফলে নবাবের রাজস্বে পঁচিশ লক্ষ টাকা লোকসান হয় এবং ভারতীয় বণিকরাও প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে মীর কাসিম দেশীয় প্রজাদের উপর থেকেও শুল্ক উঠিয়ে দিয়ে বাণিজ্য করার অধিকার দেয়। এতে ইংরেজ কোম্পানি চরমভাবে তাঁর উপর রেগে যান। ৩. প্রজাদের উপর অত্যাচার: নবাবের উপর ব্যক্তিগত অপমান ছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলার জনগণের উপর নানা অত্যাচার ও উৎপীড়ন করতো। দেশীয় বণিকদের নিকট হতে পণ্যদ্রব্য কিনতে তারা ন্যায্য দামের চেয়ে অনেক কম দিত। অনেক সময় এ কম মূল্যও দেশীয় লোকেরা পেত না। অপরপক্ষে ইংরেজরা তাদের নিকট হতে চড়া দামে দেশীয় বণিকদেরকে পণ্য কিনতে বাধ্য করতো।
৪. ষড়যন্ত্রকারীদের গৃহবন্দি: সিংহাসনে আরোহণের পর মীর কাসিম তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মুরলীধর, রাজবলভ, জগৎশেঠ প্রমুখের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে তাদেরকে মুঙ্গে বন্দি করেন। এ দমননীতি ইংরেজদের স্বার্থের পরিপন্থি হওয়ায় নবাব মীর কাসিমের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করে।
বক্সারের যুদ্ধের তাৎপর্য: ভারতবর্ষের ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধকে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। । অনেকে পলাশীর যুদ্ধের চেয়ে এ যুদ্ধকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক দ্বিণ এর মতে, “পঞ্চাশী ছিল নিছক কামানের লড়াই কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল এক চূড়ান্ত যুদ্ধ।” (Plassey was a cennonade, but Buxar a decisive battle.) পলাশীর যুদ্ধ ইংরেজদের প্রভুত্ব স্থাপনে সাহায্য করে এবং বক্সারের যুদ্ধে তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ হয়। এ যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে এবং মীরজাফর ইংরেজদের পুতুল নবাব হিসেবে মসনদে পুনরায় আরোহণ করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বক্সারের যুদ্ধ ব্রিটিশ ভারতীয় ইতিহাসে অত্যধিক তাৎপর্যপূর্ণ। এ যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষের উপর ইংরেজ আধিপত্য চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।