আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি (Background of Formation of Awami League)

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি

(Background of Formation of Awami League)

 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলের উদ্ভব হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সম্পাদক তরুণ ছাত্রনেতা মুহাম্মদ শামসুল হক, যুগ্মসম্পাদক তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মলগ্নে দলটির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ (EPAML)। পরে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ কথাটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ আমজনতা বা জনসাধারণ। পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগ সাধারণ মানুষের দল হিসেবে পরিগণিত হওয়ার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচিত হয়েছিল মূলত চল্লিশের দশকের বহুমুখী রাজনৈতিক উত্থান- পতনের মধ্যে। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ বিশেষকরে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক মনোভাব এবং অগণতান্ত্রিক আচরণে ক্ষুব্ধ হন। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বেশ কয়েকজন নেতা ১৯৪৮ সাল থেকেই মুসলিম লীগের রক্ষণশীল ধারার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বিরোধের সূত্রপাত হয়। এসময় শেখ মুজিবসহ বেশ কিছু তরুণ নেতৃত্ব রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসে এবং বিরোধী প্লাটফর্ম গঠনের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পিছনে ছাত্র ও যুব রাজনীতি অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে।

 

নিম্নে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করা হলো:

১. লাহোর প্রস্তাবের পরিবর্তন: ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি গঠন এবং মুসলমানদের স্বার্থ সম্বলিত ‘লাহোর প্রস্তাব’ গৃহীত হয়। এটিকে পাকিস্তান প্রস্তাবও বলা হয়। এ প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। এ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল…. ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো এমনভাবে চিহ্নিত করে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে যাতে করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে এমন কতকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে, যেখানে প্রত্যেকটি ইউনিট হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত। (…that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial

 

readgustment of as may be necesary that the areas in the North- Western and Eastern zones of India should be grouped to constitute Inedpedent states, in which constituent unit shall be autonomous and sovereign….)” এ প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং সার্বভৌমত্ব থাকার কথা। কারণ লাহোর প্রস্তাবে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে জিন্নাহর কূটকৌশলে ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সংসদীয় সদস্যদের সম্মেলনে (Legislators convention) মুদ্রণ ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করে States এর স্থলে State কথাটি বসিয়ে লাহোর প্রস্তাবের সংশোধন করা হয়। এতে করে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী এবং আবুল হাশিম স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এতে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে এ অংশের মতানৈক্য ও দূরত্ব তৈরি হয়, যা তাদেরকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে উৎসাহিত করে।

 

২. মুসলিম লীগের দলীয় অন্তর্কোন্দল: ১৯৪০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রধান তিনটি ধারায় বিভক্ত ছিল।

 

এক, ঢাকা বা নাজিমুদ্দিন গোষ্ঠী

 

দুই, সোহরাওয়ার্দী গোষ্ঠী;

 

তিন, ফজলুল হক গোষ্ঠী

 

ঢাকা বা নাজিমুদ্দিন গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিল নবাব পরিবারের সদস্য ও নবাব স্যার সলিমুল্লাহর বংশধর খাজা নাজিমুদ্দিন ও মাওলানা আকরাম খাঁন। এ গোষ্ঠী ছিল ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল এবং সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন। ঢাকার বাইরে সাধারণ মানুষের উপর এ গোষ্ঠীর প্রভাব ছিল সামান্য। অপরদিকে সোহরাওয়ার্দী গোষ্ঠী ছিল যথেষ্ট আধুনিক এবং প্রগতিশীল। যুব সম্প্রদায় এবং ছাত্রসমাজ ছিল এ গোষ্ঠীর প্রধান শক্তি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির শহরকেন্দ্রিক শ্রমজীবী মানুষের উপর এদের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। শেখ মুজিব ছিলেন এই গোষ্ঠীর যুব নেতা। অন্যদিকে ফজলুল হক গোষ্ঠীর প্রতি গ্রামীণ কৃষক শ্রেণির যথেষ্ট সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে গোষ্ঠীটি তখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

 

 

 

ভারত বিভাগের প্রাক্কালে এবং পরবর্তীতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে সোহরাওয়ার্দী

 

এবং ফজলুল হক গোষ্ঠী বিশেষ করে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে ভিন্নমতের কারণে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরাগভাজনের শিকার হন। ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে খাজা নাজিমুদ্দিনকে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। দেশ বিভাগের পর তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। এভাবে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করায় এবং প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার কারণে সোহারাওয়ার্দী ও ফজলুল হক গোষ্ঠীকে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর সমর্থিত ছাত্র ও যুব সংগঠনের উপর নেমে আসে সরকারি নিপীড়ন ও নির্যাতন। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। পরে তাঁর গণপরিষদের সদস্যপদও বাতিল করা হয়। কিন্তু সোহরাওয়াদী গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এরূপ অগণতান্ত্রিক আচরণ সহজে মেনে নিতে পারে নি। তারা মুসলিম লীগের বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর পাশাপাশি মাওলানা আবদুল হামিদ খাঁন ভাসানীও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন মতের কারণে নতুন দল গঠনের চিন্তা করতে থাকেন যাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।

 

৩. রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে যে বিরোধ ও আন্দোলনের সৃষ্টি হয় তার মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচিত হয়েছিল। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ ভাগ লোকের ভাষা ছিল বাংলা। পক্ষান্তরে ৩.৩% লোকের ভাষা ছিল উর্দু।” স্বভাবতই বাংলা ছিল রাষ্ট্র ভাষার অন্যতম দাবিদার। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা প্রশ্নে জিন্নাহসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে পূর্ণ সমর্থন জানান। এতে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধ নতুন মাত্রা লাভ করে। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। শেখ মুজিব ছিলেন মুসলিম ছাত্র লীগের অন্যতম নেতা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ তাঁর বক্তব্যে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে ছাত্র সংগঠনটি তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এ ছাত্র সংগঠনটির সাথে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ বিশেষকরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তখন থেকেই সোহরাওয়ার্দী অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

 

 

 

৪.  এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তান আন্দোলন ও বাস্তবায়নে পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান ছিল অপরিসীম। এতদাঞ্চলের অবহেলিত, দরিদ্র সাধারণ মানুষ আর্থসামাজিক মুক্তির প্রশ্নে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অবাঙালি এলিট এবং সামন্ত শ্রেণির নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ কোন বাস্তব ও কার্যকর অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রদানে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু বাঙালিদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং এক চোখা নীতির ফলে অচিরেই সাধারণ মানুষের মোহভঙ্গ ঘটে। এর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ধারার সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এরূপ একটি সংগঠন হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। মুসলিম লীগের কতিপয় প্রগতিশীল তরুণ সদস্যদের দ্বারা ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।১০ সম্মেলনে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি মনোনীত হন তসাদ্দুক আহমদ চৌধুরী। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পিছনে ছাত্র ও যুব নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, তাজউদ্দিন আহমদ, নুরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। বস্তুত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর শেখ মুজিবুর রহমানসহ এসব ছাত্র নেতৃবৃন্দ ১৫০ নম্বর মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প বা পার্টি হাউজে পাকিস্তানে বিশেষকরে পূর্ব বাংলায় তাদের রাজনৈতিক ধারা ঠিক করার জন্য যে বৈঠকে মিলিত হয় তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলা গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভূতপূর্ব ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসানাত সাহেবের বেচারাম দেউড়ির বাসায়।” প্রতিষ্ঠার পর এর কার্যক্রম পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। কিন্তু সরকারের দমননীতি এবং নির্যাতনের ফলে সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘটে। এতদসত্ত্বেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি প্রগতিশীল প্রতিবাদী রাজনীতির ধারার সূচনা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ আন্দালন সংগ্রামের জন্য পূর্ব বাংলার ছাত্র ও যুব কর্মীদের সংগঠিত করার সুযোগ পান। মূলত যুবলীগ গঠনের মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।’

 

 

 

৫. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ: আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সাথে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না। ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের’ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে এ ছাত্র সংগঠনের জন্য হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র কর্মী সভায় সংগঠনটির জন্ম হয়। মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে গঠিত আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমুদ্দীন আহমদ। অলি আহাদ ছিলেন ঢাকা কমিটির আহ্বায়ক। শেখ মুজিব এ কমিটির ফরিদপুর অঞ্চলের সদস্য মনোনীত হন। রাষ্ট্র ভাষাকে কেন্দ্রে করে এ সংগঠনটির জন্ম হলেও এটি পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনয়ন করতে সক্ষম হয়। বস্তুত ছাত্রলীগের মধ্য থেকেই বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

 

৬. মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প: ঢাকার ১৫০ মোগলটুলী পার্টি হাউজ ছিল পূর্ব বাংলার তরুণ লীগ কর্মীদের প্রধানকেন্দ্র। ১৯৪৪ সালে আবুল হাশেমের নির্দেশে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপের হেড কোয়ার্টার আহসান মঞ্জিলের বিপরীতে সোহরাওয়াদী-হাশিম গ্রুপের সহায়তায় এটি গড়ে উঠে। এটি ছিল তখন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের দফতর, বিশ্রামাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হক ছিলেন ১৫০ মোগলটুলীর সার্বক্ষণিক নেতা ও কর্মী। এছাড়াও এখানে সবসময় কর্মতৎপর ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবদুস সবুর খান, কামরুদ্দিন আহমেদ, মিসেস আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। এসব উদারপন্থি নেতাদের সাথে মুসলিম লীগের রক্ষণশীল অংশ মাওলানা আকরাম খান ও নাজিমুদ্দিন গ্রুপের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে এসব তরুণ নেতৃবৃন্দ একটি সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করে। মূলত ১৫০ মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের প্রচেষ্টায় আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।

 

এভাবে পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ববঙ্গ বিরোধী কার্যকলাপ, ভাষা সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ, সাধারণ জনজীবনের বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটনাবলি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল এবং তরুণ অংশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দমন নীতি পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজকে দারুণভাবে হতাশ করে। এরূপ আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পটভূমি প্রস্তুত করে দেয়।