সামরিক আমলার উদ্ভব কবে হয়েছিল?

সামরিক আমলার উদ্ভব

পাকিস্তান রাষ্ট্রে ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক আইন জারি হলে দেশের ক্যান্টনমেন্ট বা গ্যারিসনগুলো এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কারণ তখন থেকে বিশেষ পরিস্থিতিতে যে প্রশাসনিক বিন্যাস হয় এবং প্রদেশগুলো যে সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়, তার ভিত্তি ছিল ক্যান্টনমেন্টগুলো এবং অঞ্চলগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন সংশ্লিষ্ট ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেড বা এরিয়া কমান্ডারগণ। বস্তুত এখান থেকেই সামরিক আমলার উদ্ভব ঘটে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায়। দেশের সেনাপ্রধান প্রধান সামরিক শাসনকর্তা এবং প্রদেশের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পদাধিকারবলে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত হন। সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রদেশগুলোর মুখ্য সচিবদের উপ-সামরিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলার সহ-সামরিক শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করা হয়। আবার এ সহ- সামরিক শাসনকর্তাদেরকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপ-সহকারী শাসনকর্তা ও সহ-সহকারী শাসনকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এভাবেই সামরিক শাসনামল উদ্ভূত সামরিক আমলাতন্ত্র দেশের সাধারণ প্রশাসনসহ আর্থ সামাজিক জীবনে প্রভাব রাখতে শুরু করে।

 

১. বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার: সামরিক শাসনামলে প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের সরাসরি বিচারের জন্য সামরিক আদালত গঠনের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। সামরিক আদেশে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেটরা ১৯৫৪ সালের পাকিস্তান ফৌজী আইনের ৯০ থেকে ১২৬ নং বিধির সাথে প্রধান সামরিক শাসনকর্তার নির্দেশিত বিধিতে বর্ণিত কার্যক্রম অনুসরণ এবং দত্ত বিধান করবেন। প্রত্যেক মামলার বিচার সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আদালতসমূহের দণ্ডাদেশ কার্যকরী হবে। এছাড়া প্রত্যেক মামলার বিবরণী পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তার নিকট পর্যালোচনা ও স্বাক্ষরের জন্য প্রেরণ করার কথা বলা হয়। উল্লেখ্য, এ সময় পূর্ব পাকিস্ত ানে ১৫টি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠিত হয়। এসব আদালতের কার্যবিধি পুনর্বিবেচনা ও স্বাক্ষরের জন্য সহ-সামরিক শাসনকর্তাদের নিকট প্রেরণের নির্দেশ ছিল।

২. নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার: ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর নির্ভর করতে হলেও পাকিস্তান আমলে সামরিক কর্মকর্তাদের বেসরকারি কর্মকর্তাদের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় নি। কারণ সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেরই ছিল প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা। সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ বেসামরিক আমলের বহু অন্যায়ের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। আইয়ুব খানও সিএসপি কর্মকর্তাদের “উচ্চতর শ্রেণিভুক্ত জাতীয়তাবিহীন ব্যক্তিবর্গ” বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত সামরিক কর্মকর্তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করে নি। আইয়ুব খানের কথিত ‘বিপ্লবী সরকারের’ ১২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় ৩ জন জেনারেল ছিলেন। সেই সাথে ২৭২ জন সামরিক কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন।

৩. প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার: সামরিক কর্মকর্তারা বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিশেষ করে সিএসপি অফিসারদের অতিরিক্ত প্রশাসনিক প্রভাব, ক্ষমতার অপব্যবহারকে ভালো চোখে দেখত না। তাই প্রশাসনকে সিএসপি কর্মকর্তাদের প্রভাবমুক্ত করার জন্য সামরিক শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছুসংখ্যক বেসামরিক কর্মকর্তাদের পদচ্যুত ও অবসর গ্রহণে বাধ্য করেন। এছাড়া সামরিক শাসনামলে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুল গঠন করা হয়। এর ফলে অর্থ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সিএসপি কর্মকর্তাদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করা হয় এবং এ পুলের ৪০% সদস্য অন্যান্য সার্ভিস থেকে বাছাই করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর পাশাপাশি বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক কার্যালয় পরিচালনার জন্য বহুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৬২ সালের ৮ জুনে। দ্বিতীয়বারের মতো আবার দেশে সামরিক শাসন জারি হয় ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চে আইয়ুব খান কর্তৃক সেনাপ্রধান জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খানের নিকট দেশের শাসনভার অর্পণ করে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর। আর এ শাসন অব্যাহত থাকে অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু তারপরেও পাকিস্তানে দুই সামরিক শাসনের মধ্যবর্তী সময়ে সামরিক আমলাদের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেলেও তা কখনো ইহারিয়ে যায় নি, বরং পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামরিক কৃত পক্ষের একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব স্থায়ী আসন দখল করে নেয়।