পলাশী যুদ্ধের পরিণতিতে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে।
তারা ইংরেজদেরকে অনধিকার প্রবেশকারী মনে করে। অন্যদিকে, হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম শাসনকে বিদেশি শাসন বলে মনে করতো এবং এ শাসন উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ হিন্দুরা নির্দ্বিধায় ইংরেজ শাসনের আবির্ভাবকে আশীর্বাদ রূপে মনে করতো। সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায়ও এ মনোভাবের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তিনি মুসলিম শাসন অপেক্ষা ইংরেজ শাসনকে শ্রেয়তর মনে করতেন। প্রসন্ন ঠাকুর স্বাধীনতার চেয়ে ইংরেজ শাসনে থাকার ইচ্ছা পোষণ করতেন। ইংরেজদের সাথে বাঙালি হিন্দুদের গভীর সখ্যতাকে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা সুনজরে দেখতে → পারে নি। ব্রিটিশ সরকারও এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ‘Devide and Rule’ নীতি অনুসরণ করে।
হিন্দু সম্প্রদায় কোম্পানি শাসনের সাথে সহযোগিতা করে এবং তাদের প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থার সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করে ক্রমশ উন্নতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। পাশাপাশি উনিশ শতকের প্রথম থেকেই তারা ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে থাকে। তাদের মধ্যে একটি অংশ সরকার আশ্রিত ও আশীর্বাদপুষ্ট জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।
অন্যদিকে, মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের সাথে প্রথম থেকেই অসহযোগিতা করে একদিকে যেমন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষা-দীক্ষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে পড়ল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যখন হিন্দুদের রক্ষণশীলতা ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার এবং তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার তাগিদে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখ ধর্ম ও সমাজসংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে, তখন মুসলিম সম্প্রদায় থেকে এ ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। মুসলমানদের মধ্যে যে ক’জন ধর্মীয় সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে, তারা আধুনিক শিক্ষার অভাবে কোন বাস্তবসম্মত পথে না এগিয়ে কল্পনা, আবেগ ও ধর্মাশ্রয়ী পথে মুসলমানদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলশ্রুতিতে ফরায়েজি আন্দোলন, ওহাবী বিদ্রোহ, সিপাহিবিদ্রোহ প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিকে আধুনিক শিক্ষা, সংস্কৃতি বর্জনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করতে অনেক সময় লেগে যায়।