ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিস্তার
ঔপনিবেশিক তথা ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি প্রধান সম্প্রদায়- হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঠিক কখন থেকে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের দ্বারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের সূত্রপাত হয়। কিন্তু ড. স্ট্যানলি ওলপার্ট দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “হিন্দু-মুসলমান সংঘাত নতুন কিছু নয়। এটা ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি সামাজিক সমস্যা। দীর্ঘ কয়েক শ বছর পারস্পরিক সহ-অবস্থানে থেকেও ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত দূর হয়নি।” তবে বিভিন্ন ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বাংলায় এ সাম্প্রদায়িকতা উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে গতিসঞ্চার করতে থাকে, যার সামান্য পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের মধ্য দিয়ে।
সাম্প্রদায়িকতা: ইংরেজি Communalism শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। মূল শব্দের আভিধানিক অর্থের সঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিভাষার সাম্প্রদায়িকতা শব্দের অর্থগত মিল নেই। ভারতীয় রাজনীতিতে এ শব্দটি প্রধানত হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরোধ ও বিদ্বেষ সূত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবু সাইয়িদ সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বুঝেছেন তা হলো, “ধর্মের চেয়ে ধর্ম সম্প্রদায়কে এবং ব্যক্তির চেয়ে গোষ্ঠীকে বড় করে দেখা। যে নিজেকে সবসময় হিন্দু বা মুসলমান বলে ভাবতে অভ্যস্ত, অন্যের সঙ্গে পরিচিত হলে তার চরিত্র, বিদ্যাবুদ্ধি, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদির খোঁজ না নিয়ে প্রথমেই জানতে চায় লোকটি ব্রাহ্মণ না শূদ্র, হিন্দু না মুসলমান, ইহুদি না খ্রিস্টান সে সাম্প্রদায়িক মানুষ।” বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিতে, “কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্ম সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।”
সামাজিক ক্রিয়াকানুনের দিক থেকে হিন্দু সমাজ অনমনীয়, কিন্তু ধর্মের বিষয়ে উদার। মুসলমানরা তার বিপরীত। তারা ধর্মের ক্ষেত্রে কঠোর কিন্তু সামাজিকতার ক্ষেত্রে উদার। শহুরে হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে বর্ণাশ্রমের সামাজিক প্রাচীর ভাঙ্গা অতি সামান্য হলেও মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের কোন ক্ষেত্রেই সামাজিক সম্পর্ক- অর্থাৎ খানাপিনা ও বিবাহ সম্পূর্ণ অচল। তাছাড়া উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে গোমাংস পারস্পরিক সংমিশ্রণের পথে এক মস্তবড় বাধা।