অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ

অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ

 

১. কংগ্রেসের হাইকমাণ্ডের বিরোধিতা: কংগ্রেসের হাইকমাণ্ড কখনোই অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন করে নি। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনাকে ‘একটি ফাঁদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্যাটেল বাংলার প্রভাবশালী হিন্দু ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে এ ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য সতর্ক করে দেন। অধিকন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাগকে এ শর্তে মেনে নিতে চেয়েছিল যে, বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু-মুসলমান অধিবাসী এলাকা হিসেবে ভাগ করতে হবে। এমনকি মহাত্ম গান্ধী অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিটি কৌশলে এড়িয়ে যান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলীর বক্তব্যে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খুব শিঘ্রই ইংরেজদের ভারত ত্যাগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ অবস্থায় দেরি না করে কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা’ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলাকে বিভক্ত করে কলকাতাসহ হিন্দু প্রধান এলাকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠন এবং এ নতুন প্রদেশকে ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তকরণের আন্দোলন শুরু করে।

 

২. মুসলিম লীগ হাইকমাণ্ডের কৌশলগত নিষ্ক্রিয়তা: বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রশ্নে এ সময় মুসলিম লীগের হাইকমাণ্ড পক্ষেও না, আবার বিপক্ষেও না -এরকম অবস্থান গ্রহণ করে এবং এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে। মুসলিম লীগের কর্ণধার জিন্নাহর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান নামক একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অখণ্ড বাংলার আন্দোলন চলাকালে জিন্নাহ বিভিন্ন কারণে বাংলাকে স্বাধীন মর্যাদাদানে সম্মত থাকলেও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে তিনি তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন নি, বরং সোহরাওয়ার্দী হাশিম যখন অন্য সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের সাথে সমঝোতার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জিন্নাহর অনুগত খাজা গ্রুপ এমন ধারণা লাভ করেছিল যে, হিন্দু নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য লীগের হাইকমান্ড কাউকে ক্ষমতা দেয় নি। এভাবে জিন্নাহ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উভয় গ্রুপকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন।

 

 

৩. প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সোহরাওয়াদী-হাশিম গ্রুপের কাছে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাটি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে প্রণীত এবং ‘পাকিস্তান’ ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা চেয়েছিল পাকিস্তান পরিকল্পনার প্রতি বাংলার হিন্দুদের বিরোধিতা দূর করে এর মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ববঙ্গকে আর্থিক ও সামরিক দিক দিয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ গ্রুপ আরো মনে করে, অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকতা বিবেচনায় বাংলা সর্বদাই অভিভাজ্য। কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপ মনে করে যে, পাকিস্তানের সাথে বন্ধনহীন অবস্থায় বাংলার মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্থানের শক্তি মোকাবিলা করতে সমর্থ হবে না এবং কালক্রমে বাংলা ভারতের একটি অংশে পরিণত হবে। তাই এ গ্রুপটি চেয়েছিল, বাংলা বিভক্ত হোক বা না হোক, পাকিস্তানের একটি অংশেই পরিণত হোক।

 

 

 

৪. পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের গুরুত্ব কলকাতা শহরকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সম্পদ, সমৃদ্ধি ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে কংগ্রেসের হাইকমাও ও হিন্দু সম্প্রদায় এগুলোর উপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে তৎপর ছিল। কলকাতাসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলার অর্ধাংশ পেলে বাংলার বিভক্তিতে পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের কোন ক্ষতি ছিল না। জিন্নাহ নিজেও মনে করতেন, কলকাতা ছাড়া বাংলার কোন মূল্য নেই। অন্যদিকে, আসাম পেট্রোল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে ভরপুর ছিল। কৌশলগত দিক থেকেও আসাম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বাংলা অখণ্ড থাকলে তা আসামকে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এসব কারণেও কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দের সিংহভাগই বঙ্গ ভঙ্গের পক্ষে সোচ্চার ছিল।

 

সময়ের সীমাবদ্ধতা: অনেকের মতে, অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এসেছে অনেক দেরীতে। তাই এটা ফলপ্রসূ হতে পারে নি। ১৯৪৭ সালের ২৬ এপ্রিল ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে সাক্ষাৎ করে সোহরাওয়ার্দী জানান যে, “পর্যাপ্ত সময় পেলে তিনি বাংলার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।” এ সময় ভাইসরয় তাঁকে জানান যে, বাংলাকে অবিভক্ত ও স্বাধীন রাখার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে তিনি সর্বোচ্চ দু’মাস সময় পেতে পারেন। কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা বাদ দিলেও নিজ দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেখানে প্রকট, ঐকমত্যে আসার ক্ষেত্রটি যেখানে সংকুচিত, সেখানে মাত্র দু’মাসে একটি নতুন স্বাধীন ও অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সত্যই দুরূহ ব্যাপার ছিল।

 

 

 

ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ঐ সময় এ. কে. ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ছিলেন জনপ্রিয় বাঙালি নেতা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, অবাঙালি মুসলিম নেতারা বাংলার মুসলমানদের বিশেষ কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না এবং কর্তৃত্ব চলে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। তাই তাঁদের আগ্রহ ছিল বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রতি। কিন্তু তাঁদের এ পরিকল্পনাকে যৌক্তিক পরিণতীতে “নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা দূরদর্শিতা ও সমন্বয় করার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন নি। এ ব্যর্থতায় বিভিন্ন কারণ থাকলেও তাঁদের মধ্যকার ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল থাকায় এ পর্যায়ে তাঁরা সফলকাম হতে পারেন নি। মুসলিম লীগের হাইকমাণ্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বাঙালি নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় সম্পর্ককে তাঁদের পরিকল্পিত একক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে কাজে লাগিয়েছিল।

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বহুবিধ কারণে দেশ বিভাগের প্রক্কালে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। বাংলার তৎকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে দুই সম্প্রদায়ের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ বিবেচনায় একটি বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠা কঠিন ব্যাপার ছিল। তবে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় যদি ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের প্রতি অবিচল থেকে স্ব-স্ব হাইকমাণ্ড থেকে অনুমোদন নিতে পারতো। তাহলে এ উদ্যোগ অবশ্যই সফলত হতো বলা যায়। তখন বাংলার চিত্র অন্যরকম হয়ে উঠত। সোহরাওয়ার্দীর মতে, হিন্দু ও মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে এটা একটি মহান দেশে পরিণত হতো, ভারতীয় উপমহাদেশে যা হতো সবচেয়ে সমৃদ্ধ।