বঙ্গভঙ্গ কাকে বলে?

 

 

বঙ্গভঙ্গ

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়ে ছিল। পরবর্তীকালে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারতের বড়লাট হিসেবে নিযুক্ত হয়ে এত বড় প্রদেশকে একটিমাত্র প্রশাসনিক ইউনিটের অধীনে রাখা অনুচিত মনে, করেন। আর্থ-সামাজিক কারণ ছাড়াও মূলত শাসনকার্যের সুবিধার্থে লর্ড কার্জন বাংলার পূর্বাঞ্চল ও আসাম নিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা করে তা অনুমোদনের জন্য তদানীন্তন ভারত সচিব ব্রডারিকের নিকট ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেরণ করেন। এরপর বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা অনুমোদিত হয় এবং ১৯০৫ সালের ১০ জুলাই তা প্রকাশিত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগসমূহ নিয়ে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়। নতুন প্রদেশ থেকে দার্জিলিং বাদ যায় কিন্তু জলপাইগুড়ি, পার্বত্য ত্রিপুরা এবং মালদহ সংযুক্ত হয়। ঢাকা এ নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী হয়। এ প্রদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৬ হাজার ৫ শত ৪ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ, যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান, ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু এবং বাকি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলা পূর্বের বঙ্গদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সির অধীনে থেকে যায়। এর আয়তন ১ লক্ষ ৪১ হাজার ৫ শত ৮০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ, যার মধ্যে ৪ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু, ৯০ লক্ষ মুসলমান এবং বাকি অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক ছিল।

 

লর্ড কার্জনের মতে, বঙ্গ ভঙ্গের ফলে পূর্বাঞ্চলের অবহেলিত পিছিয়ে পড়া জনগণের শিক্ষা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি হলে তারা ক্রমান্বয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অধিক ভাগ্যবান এবং উন্নত ভাইদের সমপর্যায়ে যেতে পারবে। পরিণতীতে ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতির উন্নতি হবে। কিন্তু বঙ্গ ভঙ্গের প্রস্তাব প্রথম থেকেই বাংলার হিন্দুরা বিরোধিতা করে আসছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গ ভঙ্গ কার্যকর করা হবে এটা জেনে হিন্দু নেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় এবং এ ব্যবস্থা যাতে কার্যকর না হয়, সে জন্য তারা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন। তারা সংবাদপত্রে, বক্তৃতা, বিবৃতিতে একে ‘বাঙালি বিরোধী’ ‘জাতীয়তা বিরোধী’ এবং ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করে। তাদের বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধিতার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। তারা মনে করতো বঙ্গ ভঙ্গের ফলে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার নিপীড়িত মুসলমান কৃষক সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাবোধ জাগ্রত হবে। ফলে হিন্দু জমিদার ও বুদ্ধিজীবীরা মুসলমানদের উপর তাদের এতদিনকার প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব হারাবে। ঢাকায় নতুন প্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হলে এতদাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী কলকাতার প্রাধান্য ও সমৃদ্ধি হ্রাস পাবে এবং সেখানকার ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিঘ্ন ঘটবে এটাও তাদের আশঙ্কা ছিল। এছাড়া কলকাতাভিত্তিক আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি,

যাদের সিংহভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, তারা তাদের স্ব-স্ব পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কাশিমবাজারের মহারাজা মহেন্দ্র চন্দ্র নন্দী ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় বলেন, “নতুন প্রদেশে মুসলমানেরা হবে সংখ্যাগুরু আর বাঙালি হিন্দুরা হবে সংখ্যালঘু। ফলে স্বদেশেই আমরা হব প্রবাসী। আমাদের জাতির ভাগ্যে ভবিষ্যতে যে কি হবে তা চিন্তা করে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি।”

 

অন্যদিকে, বঙ্গ ভঙ্গের বিপক্ষে হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতা ও আন্দোলনের প্রকৃতি দেখে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ বলেন, “হিন্দুগণ কালক্রমে বুঝতে পারবে যে, পূর্ব বাংলা প্রদেশ স্থাপিত হওয়ায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণ বিভক্তি হয় নি বরং দুটি সহোদরা প্রদেশের শাসন, শিক্ষা প্রভৃতির উন্নতির সুব্যবস্থা হবে এবং বাঙালি জাতি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।” এ অবস্থায় নিখিল ভারত কংগ্রেসের ভূমিকাও ছিল সাম্প্রদায়িক। যে দিন সরকারিভাবে বঙ্গ ভঙ্গ ঘোষিত হলো, সেদিন কংগ্রেস দেশব্যাপী শোক দিবস পালন করে। বাঙালির ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক ‘রাখীবন্ধন’ ধারণ করে, ১৬ অক্টোবর উপবাস করে, সর্বপ্রকার কাজকর্ম বন্ধ রাখে এবং আত্মশুদ্ধির জন্য সকালে খালি পায়ে হেঁটে গঙ্গা স্নানে যায়। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন দ্রুত মুসলিম বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।