সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে? সামাজিক পরিবর্তনের কারণ কি কি?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সামাজিক পরিবর্তন বলতে বোঝায় সময়ের সাথে সাথে মানুষের আচরণের ধরণ এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও নিয়মে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। অর্থাৎ যখন সামাজে মানুষের আচরণ ও মূল্যবোধ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কাঠামো এবং সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে তখন তাকে সামাজিক পরিবর্তন বলে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা ইতিহাসের শুরু থেকে চলে আসছে এবং চলমান থাকবে।

পরিবর্তন কি?

পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তন বলতে বোঝায় কোনো কিছুর পরিবর্তন বা পার্থক্য। এটি প্রকৃতির সর্বজনীন নিয়ম। এটি অতীত এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য বোঝায়। পরিবর্তন একটি “চলমান” প্রক্রিয়া, কোনো সমাজই সম্পূর্ণ স্থির থাকে না।

সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে এবং এর ব্যাখ্যা?

সমাজ হচ্ছে গতিশীল এবং পরিবর্তনশীলতা এর ধর্ম। কোনো সমাজই কখনো একই থাকেনি। পরিবর্তন সবসময় ঘটছে এবং আমরা পরিবর্তনকে অনিবার্য হিসাবে গ্রহণ করি। সমাজের কাঠামোর পরিবর্তনই (পুনর্গঠন বা রূপান্তর) হলো সামাজিক পরিবর্তন। এখানে কাঠামো হলো সমাজের প্রধান দল ও প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সামাজিক রূপ থেকে অন্য আরকটি সামাজিক রূপে ধারণ করাকেই সামাজিক পরিবর্তন বলে।

আজ থেকে ১০ বছর আগে আপনি যে জীবন যাপন করেছিলেন বর্তমান সময়ে আপনি অবশ্যই ঐরকম জীবন যাপন করছেন না। বরং ১০ বছর আগের থেকে বর্তমান জীবন যাপনে আসনে নানন পরিবর্তন। আবার বর্তমানে আপনি যে জীবন অতিবাহিত করছেন আজ থেকে ১০ বছর পর বর্তমানের মতো থাকবে না বরং সমাজের বিভিন্ন কাঠামো পরিবর্তন হবে। আর আমরা সবসমই সমাজের এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেই।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনেক ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে যেমন: জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, পরিবেশগত পরিবর্তন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, নগরায়ন ও বিশ্বায়ন পরিবর্তন ইত্যাদি। এই সময়ে আমাদের দেশে কিছু জিনিস খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে, কিছু জিনিস ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে, কিছু জিনিস পরিবর্তন হচ্ছে এবং কিছু জিনিস অপরিবর্তিত রয়েছে। পরিবর্তনের এই ধারায় বাংলাদেশের সমাজও কমবেশি পরিবর্তিত হয়েছে।

সামাজিক পরিবর্তন এর ১০টি উদাহরণ:

  1. পূর্বে আমাদের দেশের কৃষক লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করতে কিন্ত বর্তমানে আমরা দেখতে পাই লাঙ্গল এর পরিবর্তে ট্রাক্টর এর ব্যবহার।
  2. আগে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিটিভি দেখতেন কিন্ত সময়ের সাথে সাথে বর্তমানে আমরা অনেক দেশি ও বিদেশি চ্যানেল দেখতে পারি।
  3. ১০ বছর আগে আমাদের দেশের তরুণরা যে পোশাক ব্যবহার করত এখন তরুণদের মধ্যে পোশাকের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
  4. পূর্বে আমাদের দেশের বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য চক ও বোর্ড ব্যবহার করা হতো কিন্তু বর্তমানে আমরা খাতা ও পেন্সিল ব্যবহার করি এমন কি অনেকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে।
  5. বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে পড়াশোনা করা হয়।
  6. আগে আমাদের দেশে বেশিরভাগ যৌথ পরিবার ছিলো কিন্তু বর্তমানে তা ভেঙ্গে একক পরিবার হয়ে উঠেছে।
  7. বর্তমানে আমারা বিদ্যুতের বাতি দিয়ে পড়াশোনা করি কিন্তু আজ থেকে ১০-২০ বছর পূর্বে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই কেরোসিনের আলোয় ( কুপি বাতি) দিয়ে পড়তাম।
  8. বর্তমানে আমাদের দেশের মধ্যে ফাস্টফুড জাতীয় খাবারগুলি খুব জনপ্রিতা বাড়ছে কিন্তু পূর্বে তা ছিলো না।
  9. এখন প্রায় সকলের হাতই স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেখা যায় কিন্তু আজ থেকে ১০-২০ পূর্বে একটি ফোন কল করার জন্য এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হতো।
  10. আমরা এখন আগের তুলনায় উন্নত জীবন-যাপন করতে পারছি এবং কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধনের পাশাপাশি বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতে: সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে?

ম্যাকাইভার মতে, “সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন”।

উইলিয়াম এফ অগবার্ন এর মতে, “সমাজে বসবাসরত মানুষের কৃষ্টিগত ও সংস্কৃতিগত পরিবর্তনের নামই সামাজিক পরিবর্তন”।

স্যামুয়েল কোয়েনিগ এর মতে, “ সামাজিক পরিবর্তন দ্বারা কোনো জাতির জীবনযাপন পদ্ধতির রূপান্তর, সংশোধন ও পরিবর্তনকে বোঝায়”।

গার্থ ও মিল্স এর মতে, “কালের গতিতে রীতিনীতি বা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটে থাকে তাকে সামাজিক পরিবর্তন বলে”।

কার্ল মার্কস এর মতে “সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের মৌল কাঠামো বা অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন যার উপর ভিত্তি করে সমগ্র উপরিকাঠামোর পরিবর্তন সংঘটিত হয়”।

কিংসলে ডেভিস বলেন “সামাজিক পরিবর্তন বলতে শুধুমাত্র সামাজিক সংগঠনে, অর্থাৎ সমাজের গঠন ও কার্যাবলীতে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনকেই বোঝায়”।

লুন্ডবার্গ বলেন “সামাজিক পরিবর্তন বলতে বোঝায় আন্তঃ-মানব সম্পর্ক এবং আচরণের মানদণ্ডের প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্নে যে কোনো পরিবর্তন”।

সামাজিক পরিবর্তন এর বৈশিষ্ট্য কি কি?

  1. সর্বজনীন
  2. ক্রমাগত
  3. অনিবার্য
  4. অস্থায়ী
  5. অনিশ্চিত
  6. পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত হতে পারে ইত্যাদি।

সামাজিক পরিবর্তনের কারণ সমূহ কি কি?

  1. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
  2. রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব
  3. অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রভাব
  4. ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তন
  5. সাংস্কৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন
  6. বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন
  7. বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রভাব
  8. ব্যক্তিত্বের প্রভাব
  9. সংস্কার ও বিপ্লব
  10. শ্রেণীসংগ্রাম
  11. আধুনিকীকরণ
  12. নগরায়ন

সামাজিক পরিবর্তনের অসংখ্য এবং বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত চারটি সাধারণ কারণ হল প্রযুক্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, জনসংখ্যা এবং পরিবেশ। এই চারটি ক্ষেত্রই প্রভাব ফেলতে পারে কখন এবং কীভাবে সমাজ পরিবর্তন হয়। এবং এগুলি সবই আন্তঃসম্পর্কিত: একটি ক্ষেত্রের পরিবর্তন সর্বত্র পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ভৌগোলিক পরিবেশও সমাজিক পরিবর্তন ঘটায়। যেমন: জলবায়ু, ঝড়, সামাজিক ক্ষয়, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা ইত্যাদি অবশ্যই সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে এবং সামাজিক পরিবর্তন ঘটায়। মানুষের জীবন পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থার সাথে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ।

 

 

 

 

 

 

 

অর্থনৈতিক কারণগুলি সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর গঠন করে। মার্কস বলেছিলেন যে একটি দেশের সমগ্র সামাজিক কাঠামো অর্থনৈতিক কারণের দ্বারা নির্ধারিত হয় অর্থাৎ উৎপাদন এবং বণ্টনের বস্তুগত উপায় উৎপাদন ও বন্টন। উৎপাদনের উপায়ে অর্থাৎ সমাজের বস্তুগত উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন হলে তা সর্বদাই সামাজিক সংগঠনের পরিবর্তন ঘটায়।

জনসংখ্যাগত কারণগুলি সর্বদা সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এবং প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাস সর্বদা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আসে।  যখন জনসংখ্যা কমতে থাকে, তখন কম দক্ষ কর্মশক্তি পাওয়া যায় যার ফলে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না। সমাজে লিঙ্গের অনুপাত সামাজিক শৃঙ্খলাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন: সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি হলে, তখন বহুবিবাহের প্রথা চালু হয়।

সাংস্কৃতিক পরিবেশও সামাজিক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখে। আমাদের সামাজিক জীবন নির্ভর করে আমাদের বিশ্বাস, ধারণা, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির উপর। এগুলোর পরিবর্তন হলে তা সমাজজীবনকে প্রভাবিত করে। আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলি সর্বদা সামাজিক পরিবর্তনের বড় এবং শক্তিশালী কারণ হিসাবে কাজ করে।