ইংরেজি Dictionary শব্দের বাংলা অর্থ অভিধান বা শব্দকোষ। আবার ‘অভিধান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অর্থসহ শব্দকোষ। এটি শব্দের সংগ্রহ জাতীয় একটি বিশাল আকৃতির গ্রন্থ। যে গ্রন্থ থেকে ঐ ভাষার শব্দসমূহ, শব্দের অর্থ, ব্যুৎপত্তি, পদ নির্ণয়, অভিধা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়, তার নাম অভিধান। অভিধান মানেই হচ্ছে শুদ্ধতার নিদর্শন।
অভিধান হচ্ছে শব্দের বিশাল ভাণ্ডার। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার হচ্ছে বাংলা অভিধান। বাংলা অভিধান জানিয়ে দেয় বাংলা শব্দের শুদ্ধরূপ, কোন শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসে বাংলায় মিশেছে। পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত। সব উন্নত ভাষারই অভিধান বা শব্দকোষ আছে। বাংলা ভাষায়ও সংকলিত হয়েছে সমৃদ্ধ অভিধান। এটি বানান সম্পর্কে ভালো ধারণা লাভের নির্ভরযোগ্য সংকলন।
অভিধানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অভিধান সংকলনের ইতিহাস নতুন নয়। এর সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টের জন্মেরও অনেক আগে। তখন থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, চর্চা এবং ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের তালিকা, অর্থ এবং উৎপত্তি প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা স্থান পায় অভিধানে। সংকলিত শব্দকোষকে গ্রিকরা বলত ‘লেক্সিকন’ আর রোমানরা লাতিন ভাষায় এর নাম দিয়েছিল ‘ডিকশনারি’।
আঠারো শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্তুগিজ ধর্মযাজক মনো এল দা আসসুম্পসাঁউ ঢাকার ভাওয়ালে অবস্থানকালে ১৭৩৪ সালে একটি দ্বিভাষিক অভিধান সংকলন করেন। তাঁর সংকলিত অভিধানের নাম ‘ভোকাবুলারিওএম ইদিওমা বেনগলা ই পর্তুগিজ’ (Vocabularioem idiom Bengala e Protugez)। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা-পর্তুগিজ ভাষার প্রথম অভিধান। ইতিহাসের বিচারে তাই মনোএল দা বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান সংকলক। পর্তুগালে তাঁর নাম মুছে গেলেও বাংলা ভাষার ইতিহাসে তিনি অমর।
মানোএল দার পর অভিধান সংকলনে ইংরেজরা কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। অভিধানে তারা সংকলন করেন প্রচুর আটপৌরে শব্দ। তারা বহু শব্দের ভুল রূপকে শুদ্ধ মনে করেছিলেন, তাই অনেক শব্দের ভুল অর্থ লেখা হয়েছিল। ১৭৯৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলরি’। এটি বাংলা ইংরেজি অভিধান। একে বাংলা ভাষার প্রথম পরিকল্পিত অভিধান বলা যায়। ১৭৯৯ ও ১৮০২ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় এক বিশাল অভিধান। এর সংকলক ছিলেন হেনরি পিট ফরস্টার। উইলিয়াম কেরি দুই খণ্ডে বাংলা অভিধান সংকলন করেন। তাঁর অভিধানের নাম ‘এ ডিকশনারি অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়ার্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন, অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন’। এর প্রথম খণ্ড ১৮১৫ এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৮২৫ সালে প্রকাশিত হয়। এটি আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সবচেয়ে বেশি অভিধান সংকলিত হয়েছে উনিশ শতকে। গ্রেভস হটনের ‘এ ডিকশনারি বেঙ্গলি অ্যান্ড স্যানসক্রিট’ প্রকাশিত হয় ১৮৩৩ সালে। ১৮৩৪ সালে প্রকাশিত হয় রামকমল সেনের ‘এ ডিকশনারি ইন ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি’। এরপর ক্রমান্বয়ে আরও যেসব বাংলা অভিধান সংকলন ও প্রকাশিত হয়েছে, তা হলো—
১. বঙ্গভাষা অভিধান – রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ
২. বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. সরল বাংলা অভিধান – সুবলচন্দ্র মিত্র
৪. বাংলা ভাষার অভিধান – জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
৫. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান – শৈলেন্দ্র বিশ্বাস
৬. চলন্তিকা – রাজশেখর বসু
৭. ব্যবহারিক শব্দকোষ – কাজী আবদুল ওদুদ
বাংলাদেশে অভিধান প্রণয়নে বাংলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে-
- ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
- বানান অভিধান
- উচ্চারণ অভিধান
- বিজ্ঞান অভিধান
- ঐতিহাসিক অভিধান
- আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান
- বাংলা ইংরেজি দ্বিভাষিক অভিধান
অভিধান মূলত শব্দগুচ্ছ সংগ্রহ বা শব্দের সম্ভার বা জ্ঞানচর্চার নিত্য সহচর। ডক্টর আহমদ শরীফের ভাষায়, ‘অভিধান’ শব্দের অর্থ ব্যাপক ও গভীর হয়ে গেছে। এখন অভিধান নিতান্ত শব্দকোষ নয়, এনসাইক্লোপিডিয়ার কাছাকাছি জ্ঞানকোষও। এখন শব্দের মূল গঠনপ্রকৃতি, প্রত্যয়রূপ, উচ্চারণ, বিভিন্ন অর্থে সপ্রমাণ প্রয়োগ-বৈচিত্র্য, শব্দটির আদি প্রয়োগ, অর্থের প্রসার কিংবা অর্থান্তরকাল অপ্রচলিত হলে প্রয়োগ বর্জনকাল, কোনো সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পৃক্ত থাকলে তারও উল্লেখ, শব্দের পদান্তর রূপ ও প্রয়োগ প্রভৃতিও একালের একটা ভাষা-প্রতীক ও প্রতিভূ অভিধানে আলোচিত হয়।