ভাইরাস কি? ভাইরাসের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, শ্রেণিবিন্যাস, গঠন, গুরুত্ব। What is Virus?

 

 

 

 

 

 

 

 

জীববিজ্ঞানে, ভাইরাস (Virus) হলো নিউক্লিক এসিড ও প্রােটিন দ্বারা গঠিত অতিক্ষুদ্র পরজীবী, যা শুধুমাত্র উপযুক্ত পােষক কোষের ভেতরে সংখ্যাবৃদ্ধি করে কিন্তু জীবকোষের বাইরে জড় পদার্থের মতাে নিষ্ক্রিয় অবস্থান করে। এদের ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। ভাইরাসের দেহে কোষপ্রাচীর, প্লাজমালেমা, সুগঠিত নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম ইত্যাদি কিছুই থাকে না। তাই ভাইরাস দেহকে অকোষীয় বলে। এরা শুধু প্রোটিন আবরণ ও ভেতরে নিউক্লিক এসিড (DNA বা RNA) নিয়ে গঠিত। ভাইরাসের মাথা, লেজ ও স্পর্শক তন্তু থাকে।

ভাইরাসের ইতিহাস

ভাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ বিষ (poison)। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ভাইরাস সৃষ্ট মোজাইক রোগের বর্ণনা দেন বিজ্ঞানী অ্যাডোলফ মায়ার (Adolf Mayer)। তিনি তামাক গাছের পাতায় রোগ। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রুশ জীবাণুবিদ দিমিত্রি আইভানোভসকি (Dmitri Iwanowsky) তামাক গাছের মোজাইক রোগের কারণ হিসেবে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বিজ্ঞানী স্ট্যানলি (Stanley) তামাকের মোজাইক ভাইরাস (TMV)-কে রোগাক্রান্ত তামাক পাতা থেকে পৃথক করে কেলাসিত করতে সক্ষম হন। এজন্য তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পিরি (Pirie) এবং বদেন (Bawden) ভাইরাসের দেহ প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিডে গঠিত তা প্রমাণ করেন। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কারের পরবর্তী সময়ে (১৯৪০-১৯৯৬) ভাইরাসের ভৌত গঠন সম্বন্ধে নতুন নতুন ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শেফারম্যান (Shafferman) এবং মরিস (Morris) সায়ানোব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী সায়ানোফাজ আবিষ্কার করেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যালো (Gallow) মানুষের মরণব্যাধি এইডস রোগের ভাইরাস আবিষ্কার করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে মানুষের নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।

ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য

  • ভাইরাস অকোষীয়, অতিঅণুবীক্ষণিক (ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না) ও কণিকার মতাে দেহবিশিষ্ট একপ্রকার গঠন বিশেষ।
  • পূর্ণ পরজীবী; কেবল উপযুক্ত পােষকের অভ্যন্তরে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায়।
  • পােষক দেহের বাইরে ভাইরাস নির্জীব স্ফটিকের মতাে অবস্থান করে।
  • ভাইরাস রাসায়নিকভাবে নিউক্লিক এসিড ও প্রােটিন দিয়ে গঠিত। দেহে কেবল একধরনের নিউক্লিক এসিড (DNA অথবা RNA) থাকে।
  • ভাইরাসের প্রােটিনগুলাে পােষকের রাইবােজোমে সংশ্লেষিত হয়।
  • এটি প্রতিরূপ সৃষ্টি করে সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং জীবদেহের বিশেষ বিশেষ রােগ সৃষ্টি করে।
  • ভাইরাসের নিজস্ব কোন বিপাকীয় ক্ষমতা নেই; এরা এসিড, লবণ ও ক্ষার প্রতিরােধ করতে পারে।
  • এগুলাের অভিযােজন (adaptation) ক্ষমতা অসাধারণ।
  • ভাইরাসের প্রতিরােধ ক্ষমতা অনন্য, তাই অত্যন্ত ছোঁয়াচে।
  • এগুলাে আকারে বৃদ্ধি পায় না এবং বাহ্যিক কোন উদ্দীপনায় সাড়া দেয় না।

 

 

 

 

 

 

ভাইরাসের শ্রেণীবিন্যাস

অঙ্গসংস্থান, রাসায়নিক উপাদান, নিউক্লিক এসিডের গঠন ও রেপ্লিকেশনের ধরনের উপর ভাইরাসের শ্রেণিবিন্যাস নির্ভর করে। নিচে আকার ও নিউক্লিক এসিডের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস দেখানো হলো।

আকার অনুযায়ী ভাইরাসকে নিচের মতো করে ভাগ করা যায়।

দন্ডাকার (Rod-shaped): এগুলোর আকার অনেকটা দন্ডের মতো। যেমন- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV), মাষ্পস ভাইরাস ইত্যাদি।

গোলাকার (Spherical): এগুলো অনেকটা গোলাকার। যেমন- পোলিও ভাইরাস, ডেঙ্গী ভাইরাস, Human Immunodeficiency Virus (HIV) ইত্যাদি।

ঘনক্ষেত্রাকার (Cubical): এগুলো ঘনক্ষেত্রকার। যেমন- ভাকসিনিয়া ভাইরাস, হার্পিস আঁচিলের ভাইরাস ইত্যাদি।

ব্যাঙাচির আকার (Tadpole shaped): এসব ভাইরাস ব্যাঙাচির মতো মাথা ও লেজবিশিষ্ট। যেমন- T2, T4, T6 ইত্যাদি।

ডিম্বাকার: এগুলো দেখতে ডিমের মতো। যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।

ভাইরাস দেহের নিউক্লিক এসিডের ধরন অনুযায়ী ভাইরাস দু’ধরনের।

DNA ভাইরাসঃ এদের দেহে নিউক্লিক এসিড হিসেবে শুধু DNA থাকে।
  1. একক সূত্রক DNA (যেমন- কোলিফাজ ভাইরাস)।
  2. দ্বিসূত্রক DNA (যেমন- ভাকসিনিয়া ভাইরাস)
RNA ভাইরাসঃ এদের দেহে নিউক্লিক এসিড হিসেবে শুধু RNA থাকে।
  1. একক সূত্রক RNA (যেমন- TMV)
  2. দ্বিসূত্রক RNA (যেমন- রিওভাইরাস, ধানের বামন রোগের ভাইরাস)

ভাইরাসের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ভাইরাস মানবদেহে বসন্ত, হাম, সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি করে। ধানের টুংরো ও তামাকের মোজাইক রোগ ভাইরাসের কারণে হয়। ভাইরাস শুধু ক্ষতিকর জীবই নয়, মানবকল্যাণে এর বহুবিধ উপকারী ভূমিকা রয়েছে। নিচে এই অণুজীবটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো–

i. এটি রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দুর্বল করে বা মেরে ফেলে। যেমন, হাম ও পোলিও রোগের টিকা তৈরি করা হয় ভাইরাস থেকে, যা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উৎপাদন করে।

ii. ভাইরাস অবাঞ্ছিত প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের সরাসরি উপকার করে।

iii. ভাইরাস ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়ার মৃত্যু ঘটিয়ে মাটিতে সার প্রস্তুত করা যায়।

iv. এটি জীবতত্ত্বের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।

v. এটি ব্যাটেরিওফাজ ধ্বংস করে।