অনুপ্রাস অর্থ কি? অনুপ্রাস কি বা কাকে বলে? অনুপ্রাসের বৈশিষ্ট্য, উদাহরণ ও প্রকারভেদ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অনুপ্রাস’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে, যার গঠন— অনু + প্র + √অস্ + অ অথবা অনু + প্র + আস। অনুপ্রাস শব্দের অর্থ হলো শব্দালংকারবিশেষ, একই ধ্বনি ও বর্ণের পুনঃপুনঃ প্রয়োগসমন্বিত কাব্যলংকারবিশেষ।

‘অনুপ্রাস’-এর উচ্চারণ হলো ‘ওনুপ্‌প্রাশ্‌’।

অনুপ্রাস কি বা কাকে বলে?

একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তা হলো অনুপ্রাস। ‘অনুপ্রাস’-এর ইংরেজি হলো ‘Alliteration’।

অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ।একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তার নাম অনুপ্রাস। অনুপ্রাস নানাভাবে তৈরি হয়। সাধারণত শব্দের আদি, মধ্য ও অন্তে (শেষে) অনুপ্রাস থাকে।

বাক্যের প্রতিটি শব্দে একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ পুনঃপুনঃ ব্যবহার করাকে বলা হয় অনুপ্রাস। অনুপ্রাসকে দুভাবে সজ্জিত করা হয়, যথা— পূর্বভাগ (আদি) এবং উত্তরভাগ (প্রান্তীয়)। আদি অনুপ্রাসে অবশ্যই আদিতে বা প্রথমে অভিন্ন ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ হতে হবে আর প্রান্তীয় অনুপ্রাসে আদি বা শুরুর জায়গা ব্যতিত প্রতিটি শব্দের যেকোন জায়গায় অভিন্ন ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ হতে হবে।

অনুপ্রাস অভিন্ন বর্ণের ওপর নির্ভর করে আবার নাও করতে পারে। যেমন ‘ইমনের স্কুল স্টেশনে’ একটি অনুপ্রাস বাক্য, টটোগ্রাম নয় কেননা ‘স্কুল’ ও ‘স্টেশন’ প একই রকম। আদি অনুপ্রাসকে ক্রম অনুপ্রাসও বলা যায় কারণ অভিন্ন ধ্বনিটি সবসময়ই প্রথমেই হবে। আর প্রান্তীয় অনুপ্রাসকে অক্রম অনুপ্রাসও বলা যায় কারণ অভিন্ন ধ্বনিটি প্রথম স্থান ব্যতিত যে-কোনো অবস্থানে থাকতে পারে।

অনুপ্রাসের মূল বৈশিষ্ট্য

  • একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
  • একাধিকবার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
  • অনুপ্রাসের মাধ্যন্দ সৃষ্টি হয় সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের।

 

অনুপ্রাসের উদাহরণ

  • কুশল কামনা কর কুসঙ্গ করিয়া (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত) : এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।
  • কুলায় কাপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে : এখানে ‘ক’ ধ্বনি পাঁচবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।
  • গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) : এখানে ‘গ’ ধ্বনি আটবার এসেছে যা অলঙ্কার অনুপ্রাস।

 

অনুপ্রাসের প্রকারভেদ

বাংলায় অনুপ্রাস বিভিন্ন ধরনের হয়।

প্রচলিত কিছু অনুপ্রাসের প্রকারভেদ হলো—

  • অন্ত্যানুপ্রাস
  • মধ্যানুপ্রাস
  • আদ্যানুপ্রাস
  • বৃত্ত্যনুপ্রাস
  • ছেকানুপ্রাস
  • শ্রুত্যনুপ্রাস

 

এর বাইরেও বেশ কিছু অনুপ্রাস লক্ষ্য করা যায়।

 

অন্ত্যানুপ্রাস

কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃত্তিতে যে অনুপ্রাস অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস।

অর্থাৎ কবিতার দুইটি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে।

যেমন:

দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে, আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর): এখানে ‘ডোবে’ আর ‘লোভে’র অন্ত্যমিল তাই এটি অলঙ্কার অন্ত্যানুপ্রাস।

গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা / ‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি মা’ (কাজী নজরুল ইসলাম)

উচ্চ কন্ঠে উঠিল হাসিয়া তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মধ্যানুপ্রাস

কাব্যের একই চরণের মধ্যে যে ধ্বনিগুচ্ছের যে মিল থাকে তাকেই মধ্যানুপ্রাস বলে।

উদাহরণ—

  • চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা (জীবনানন্দ দাশ): এখানে ‘তার’, কবে’কার’, অন্ধ’কার’, বিদি’শার’ মধ্যানুপ্রাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

আদ্যানুপ্রাস

কবিতার দুই চরণের আদিতে যে মিল, তাই আদ্যানুপ্রাস।

উদাহরণ—

  • বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে (কাজী নজরুল ইসলাম): এখানে ‘বাবুদের’ এবং ‘হাবুদের’ যে মিল সেটাই আদ্যানুপ্রাস।

 

বৃত্ত্যনুপ্রাস

একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।

উদাহরণ–

  • সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর): এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।
  • মানুষের মনীষার মঞ্জুষার, মুগ্ধতার মহিমার- মৌনতাবাহক (আবুল হাসান (‘ম’ ৭ বার আবৃত্ত)
  • হবে সে সূর্যের সেবাদাসী (শামসুর রাহমান)
  • বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী (আল মাহমুদ)
  • চাচায় চা চায়, চাচি চেঁচায়/চা চড়াতে চায় না চাচি, চচ্চরি চুলায় (নকুল বিশ্বাস)

 

ছেকানুপ্রাস

দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দুই বার ধ্বনিত হলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস। ছেকানুপ্রাসের আবার কয়েক প্রকার বা ধরনের রয়েছে, যেমন— শ্রুত্যনুপ্রাস, লাটানুপ্রাস, মালানুপ্রাস, গুচ্ছানুপ্রাস, আদ্যানুপ্রাস বা সর্বানুপ্রাস।

মনে রাখা দরকার যে, একক ব্যঞ্জনে কোনো ক্রমেই ছেকানুপ্রাস হয় না। উল্লেখ্,  ছেকানুপ্রাসের বাস্তব ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দেখা যায় না।

উদাহরণ—

করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর): এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি অলংকার ছেকানুপ্রাস।

অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? (সুধীনদত্ত)

একমাত্র গোধূলীবেলায় সবকিছু বারাঙ্গনার মত রাঙ্গা হয়ে যায়। (শহীদ কাদরী)

নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান। (কাজী নজরুল ইসলাম)

সাপের অঙ্গের মতো ভঙ্গি ধরে টান মারে মিছিলে রাস্তায়। (আলা মাহমুদ)

 

শ্রুত্যনুপ্রাস

বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে উচ্চারিত যে সব ব্যঞ্জনধ্বনি শ্রুতিমধুর অনুপ্রাস সৃষ্টি করে তাকে শ্রুত্যনুপ্রাস বলে।

উদাহরণ—

  • চিরদিন বাজে অন্তর মাঝে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর): এখানে ‘বাজে’ এবং ‘মাঝে’ মিলে শ্রুত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি করেছে; ‘ব’ ও ‘ম’ এবং ‘জ’ ও ‘ঝ’ একই উচ্চারণের স্থান থেকে উচ্চারিত।
  • চাচায় চা চায়, চাচি চেঁচায় (নকুল বিশ্বাস)

 

সনেটে অনুপ্রাস

অনুপ্রাসক মনোরঞ্জন রায়-এর রচিত গাণিতিকধারার কাব্যগ্রন্থ ‘শব্দচড়ুই ও দিগন্তদুপুর’ থেকে সংগৃহীত দুইটি আদি অনুপ্রাস সনেট এবং প্রান্তীয় অনুপ্রাস সনেট যথাক্রমে ‘প্রহসন’ এবং ‘প্রতিদান’। মনোরঞ্জন রায় বিশ্বসাহিত্যে প্রথম অনুপ্রাস সনেট রচয়িতা।