মূল্যবোধ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Value এটি গঠিত হয়েছে তিনটি ল্যাটিন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের ভিত্তিতে। শব্দগুলো হচ্ছে: Vale (অর্থাৎ strength বা শক্তি), Val (অর্থাৎ worth বা মূল্য) এবং Valu (অর্থাৎ valor বা সাহস, পরাক্রমা, বিক্রম, শৌর্য)। সামষ্টিকভাবে এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে ‘সব উত্তম জিনিস’।
মূল্যবোধ কী? (What is Value in Bengali?)
মূল্যবোধ কথার অর্থ মূল্যবান, মর্যাদাবান বা শক্তিশালী হওয়া।
মূল্যবোধের কতগুলো সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ব্যক্তির জানা, পরিচিত বা নিজের আয়ত্তে যা কিছু আছে, তার চেয়েও অধিকতর মূল্যবান, যা কিছু সঞ্চয় করে রাখার মতো তা হলো মূল্যবোধ।
- মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ডকে মূল্যবোধ বলে।
- কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিস্বাসকে মূল্যবোধ বলে।
- সমাজবিজ্ঞানী ডেবিড পোপেনো (David Popenoe) বলেছেন, “ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষি সমাজের সদস্যদের যে ধারণা, তার নামই হলো মূল্যবোধ।
- সমাজবিজ্ঞানী এফ. ই. স্পেন্সার বলেছেন, ” মূল্যবোধ হলো একটি মানদণ্ড, যা আচরণের ভালো-মন্দ বিচারের এবং সম্ভাব্য বিভিন্ন লক্ষ্য হতে কোনো একটি পছন্দ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
- সমাজবিজ্ঞানী এফ. ই. মেরিল (F. E. Merril)-এর মতে, সামাজিক মূল্যবোধ হলো বিশ্বাসের এক প্রকৃতি বা ধরন যা গোষ্ঠীগত কল্যাণে সংরক্ষণ করাকে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
আর যে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে তাই হলো মুল্যবোধ শিক্ষা। মূল্যবোধ হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটি মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি। একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে এটি ভূমিকা পালন করে।
জন্মের পর থেকে শিশুর জীবনের বহুমুখী বিকাশ হয়। এই বিকাশের লক্ষণ প্রকাশ পায় ব্যক্তির আচরণের মধ্যে। আচরণবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়, শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার জন্মগত আচরণের মধ্যে পরিবর্তন আনতে থাকে; এই পরিবর্তিত নতুন আচরণকে বলা হয় অর্জিত আচরণ। এই অর্জিত আচরণগুলো সৃষ্টি করে, শিশু বা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত কতগুলো অর্জিত জৈব-মানসিক প্রবণতা।
যেমন: বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু কতগুলো অভ্যাস গঠন করে। পরবর্তী পর্যায়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতগুলো স্থায়ী অনুরাগ গড়ে ওঠে। আরও পরে সেন্টিমেন্ট, মনোভাব ইত্যাদি জৈবমানসিক প্রবণতাগুলো গড়ে ওঠে। পরিণত বয়সে এসব জৈব-মানসিক প্রবণতাগুলোর অভিজ্ঞতার ফলে সমন্বয় ঘটে। এ ধরনের সমন্বয়ের ফলে, যে সর্বশক্তিসম্পন্ন জৈব-মানসিক সংগঠন গড়ে ওঠে, তা ব্যক্তির সবরকম আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই জৈব-মানসিক সংগঠনই হলো মূল্যবোধ।
মূল্যবোধের উৎস কী?
মূল্যবোধের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ, বিদ্যালয়, বন্ধু বা সঙ্গী-সাথী, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, বই ইত্যাদি।
মূল্যবোধের প্রকারভেদ (Types of Value)
জীবনের বিভিন্ন স্তরে আচরণ সম্পাদনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের মূল্যমান বা আর্দশমান থাকা স্বাভাবিক। সুতরাং, ব্যক্তিজীবনের মূল্যবোধ, তার আচরণক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে ভিন্নরূপ গ্রহণ করতে পারে।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন জীবনের প্রত্যেকটি মূল্যবোধের ক্ষেত্রে দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো তার প্রকাশমান দিক, যাকে আচরণমূল্যে পরিমাপ করা যায়। অপরটি হলো তার আন্তরিক দিক, যাকে তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপ করা যায় না। মূল্যবোধের এই আন্তরিক দিকটিকে জীবনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, শিক্ষা যেহেতু একটি আদর্শ সামাজিক প্রক্রিয়া, সেহেতুতার একমাত্র দায়িত্ব হওয়া উচিত, মূল্যবোধের এই আন্তরিক দিকটি বিকাশের চেষ্টা করা।
শিক্ষাবিদগণ মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে অন্তত ছয় ধরনের মূল্যবোধ বিকাশের চেষ্টা করা প্রয়োজন।
এগুলো হলো:
- অর্থনৈতিক মূল্যবোধ (Economic Value)
- সামাজিক মূল্যবোধ (Social Value),
- শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ (Physical and Recreational Value),
- নৈতিক মূল্যবোধ (Moral Value)
- সৌন্দর্যের মূল্যবোধ (Aesthetic Value),
- বৌদ্ধিক মূল্যবোধ (Intellectual Value)
- ধর্মীয় মূল্যবোধ (Religious Value)।
অর্থনৈতিক মূল্যবোধ
সাধারণভাবে যেসব বস্তুর বিনিময়ে অর্থ লাভ করা যায় সেসব বস্তুর আর্থিক মূল্য আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বস্তুর আনন্দ প্রদানের সক্ষমতা আছে সেগুলোকে আর্থিক মূল্যসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ অর্থের সঙ্গে বস্তুসামগ্রীর বা জীবন উপভোগের সংযুক্তি আছে বলেই তার আর্থিক মূল্য রয়েছে। বস্তুজগতের সঙ্গে আনন্দানুভূতির সংযোজন প্রয়োজন। আর এ সংযোজনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ।
সুতরাং পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে উপভোগ্য বস্তুসামগ্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আনন্দানুভূতির সংযোগ স্থাপন করে ব্যক্তিজীবনে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায়। ব্যক্তির আর্থিক কার্যাবলি পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ প্রকাশ পায়।
সামাজিক মূল্যবোধ
যথাযথ পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর মানুষের সুস্থ সামাজিক জীবনযাপন নির্ভর করে। যে ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে সমাজে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম তিনিই সুস্থ সামাজিক জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত।
মনোবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, ব্যক্তির আন্তরিক মূল্যবোধের মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে যথাযথ সামাজিক সম্পর্ক নিরূপণ করা দরকার। যেমন: বন্ধুত্ব বলতে আমরা যে সম্পর্ককে বুঝাই তার মধ্যকার মানসিক সন্তুষ্টির মূলে আছে ব্যক্তির এ ধারণার প্রতি এক মূল্যবোধ। একে বলা হয় বন্ধুত্বের মূল্যবোধ। তেমনি স্নেহ, ভালোবাসা এগুলো একেকটি সামাজিক মূল্যবোধ।
শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ
মানুষের জীবনের বিভিন্ন রকম চাহিদার মধ্যে জৈবিক ও মনোবৈজ্ঞানিক চাহিদাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিজীবনে এসব জৈবিক ও মনোবৈজ্ঞানিক চাহিদাগুলো এমনভাবে পরিতৃপ্ত হতে হবে যাতে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ আদর্শ পথে হয় এবং সবশেষে ব্যক্তি আদর্শ জীবনের অধিকারী হতে পারে। এজন্য ব্যক্তির উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
নৈতিক মূল্যবোধ
জীবন চলার পথে ব্যক্তি তার কাজের পথ স্বাধীনভাবে বাছাই করে থাকে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যক্তির কী করণীয়, কী করণীয় নয় সে বিষয়ে প্রত্যেককে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ব্যক্তির এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর তার জীবনের সফলতা বা ব্যর্থ হওয়া নির্ভর করে।
তাছাড়া এই সিদ্ধান্তের যথার্থতার মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়।
যে ধরনের মূল্যবোধের মাধ্যমে এই ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বিচার করা যায়, তাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলা হয়।
নৈতিক মূল্যবোধ জাগরণের মাধ্যমে, ব্যক্তি সারা জীবনতার বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আচরণগত সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। জীবন-অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির ভালো-মন্দ বা উচিত-অনুচিত বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হয়। ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রের বিস্তৃতির সাথে সাথে এই মূল্যবোধগুলো কেন্দ্রিভূত হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে। আবার অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রক্রিয়া হচ্ছে শিক্ষা।
সৌন্দর্য সম্ভোগের মূল্যবোধ
এক বিশেষ ধরনের অনুভূতিমূলক অভিজ্ঞতা-ই হচ্ছে সৌন্দর্য সম্ভোগ। এ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তির মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি জাগিয়ে তোলা।
সৌন্দর্য সম্ভোগ তখনই সম্ভব হয় যখন আমরা কোন বস্তু, ঘটনা বা পরিস্থিতিকে পূর্ব অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এককভাবে প্রত্যক্ষ করি এবং তার ওপর আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে প্রয়োগ করি। বস্তুজগতে এভাবে প্রত্যক্ষণ, উন্নত ব্যক্তিসত্তার পরিচায়ক। আর এজন্য যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে বলে সৌন্দর্য সম্ভোগের মূল্যবোধ।
বৌদ্ধিক মূল্যবোধ
সাধারণভাবে ব্যক্তির জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াকেই বৌদ্ধিক বিকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মানুষের জ্ঞানের পরিধি এত ব্যাপক এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল যে, কোন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জ্ঞানার্জনে সম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিজীবনে বৌদ্ধিক বিকাশের প্রকৃত তাৎপর্য সত্য অনুসন্ধানের স্পৃহা জাগ্রত করা।
অর্থাৎ ব্যক্তি যখন প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করতে সক্ষম হয় তখনই ব্যক্তিজীবনের বৌদ্ধিক বিকাশ সাধন করা যায়। দার্শনিকরা বলেছেন, ব্যক্তি যখন জ্ঞানের সামগ্রীর মধ্যে আনন্দানুভূতি লাভ করবে, তখন তার মধ্যে বৌদ্ধিক মূল্যবোধ (Intellectual Value) জাগ্রত হবে। আর ব্যক্তি তখনই সত্যের অনুসন্ধান বা প্রকৃত জ্ঞানের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে যখন তার মধ্যে বৌদ্ধিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। বৌদ্ধিক বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনব্যাপী জ্ঞানানুসন্ধানে উৎসাহিত হয়।
ধর্মীয় মূল্যবোধ
মানুষের আচরণে ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব ব্যাপক। যখন কোন বস্তুকে সর্বশক্তিমান বা ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত করে মহান হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তখনই তাকে বলা হয় ধর্মীয় অভিজ্ঞতা (Religious Experience) বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা (Spiritual Experience)। এই জাতীয় অভিজ্ঞতার পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং উদার।
বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা অর্জন করার এই ধরনের ক্ষমতাকে ব্যক্তির চারিত্রিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তির চারিত্রিক বিকাশে সহায়তা করা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার একটি প্রধান লক্ষ্য।
শিক্ষার্থীরা যখন কতকগুলো মৌলিক সার্বজনীন বিশ্বাসের দ্বারা নিজের আচরণকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে তখনই তাদের চারিত্রিক বিকাশ সাধন সম্ভব হবে। তাই বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রচেষ্টাই হবে ব্যক্তির মধ্যে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। এজন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে যাতে ব্যক্তির ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ (Spiritual Experience) বিকশিত হয় সেদিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়।