এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি (X-rays or Roentgen rays in Bangla)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শরীরের কোনো অঙ্গ যেমন হাত, পা ভেঙ্গে গেলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই। চিকিৎসক আমাদের এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। এক্স-রে ফিল্মের রিপোর্ট দেখে আমরা জানতে পারি কি ধরনের সমস্যা হয়েছে। তাহলে এই এক্স-রে কী? কীভাবে তা উৎপন্ন হয়? এ ব্যাপারে আমারা বিস্তারিত আলোচনা করব।

এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি ঊনবিংশ শতাব্দির এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। 1895 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলহেলম কে. রনজেন (W. K. Röntgen) এই রশ্মি আবিষ্কার করেন। তিনি ক্ষরণ নল নিয়ে ক্যাথোড রশ্মি সম্পর্কে গবেষণা চালাবার সময় দেখতে পান যে, ক্ষরণ নলের পার্শ্বে স্থাপিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের পাতের উপর ক্যাথোড রশ্মি পতিত হয়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করেছে। তিনি একটি মোটা লাল কাগজ দ্বারা ক্ষরণ নলকে আবৃত করে পাতের উপর প্রতিপ্রভা লক্ষ করেন।

তারপর পাত এবং নলের মধ্যে পুরু ধাতব পাত স্থাপন করেও একই জিনিস দেখতে পান। তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ঐ রশ্মিসমূহ ক্যাথোড রশ্মি নয়। বরং ক্যাথোড রশ্মি ক্ষরণ নলের গায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হবার পর তা হতে বিশেষ এক প্রকার রশ্মি উৎপন্ন হচ্ছে যার ফলে ঐ প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিশেষ রশ্মির প্রকৃতি এবং ধর্মাবলি জানা না থাকায় তিনি ঐ রশ্মিসমূহের নামকরণ করেন এক্স-রে বা অজানা রশ্মি। সাধারণত অঙ্ক করার সময় অজানা রাশিকে আমরা X ধরে থাকি। বিজ্ঞানী রনজেনও তাই করছেন। আবিষ্কারকের নামানুসারে তাদেরকে রনজেন রশ্মিও বলা হয়। পরবর্তী কালে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই রশ্মিসমূহের প্রকৃতি এবং ধর্ম জানা যায়।

এক্স-রের প্রকৃতি

বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন পরীক্ষার সাহায্যে এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মির প্রকৃতি নির্ণয় করেন। এক্স-রে চার্জ যুক্ত কণা দ্বারা গঠিত নয়। এরা দৃশ্যমান আলোকের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গ আড় তরঙ্গ— লম্বিক তরঙ্গ নয়। দৃশ্যমান আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষা তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক ছোট।

এক্স-রের প্রকারভেদ (Types of X-rays)

এক্স-রে দুই প্রকার, যথা—

(১) কোমল এক্স-রে ও (২) কঠিন এক্স-রে। (১) কোমল এক্স-রে (Soft X-rays) : গ্যাস নলের ভেতরে গ্যাসের চাপ যদি অপেক্ষাকৃত বেশি হয়, তবে কম বিভব পার্থক্যেও এক্স-রশ্মি উৎপন্ন করা যায়। এই ধরনের এক্স-রশ্মিকে কোমল এক্স-রে বলে। এর ভেদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম। তবে মেডিক্যাল বিজ্ঞানে কোমল এক্স-রের ব্যবহার প্রচুর।

(২) কঠিন এক্স-রে (Hard X-rays) : নলের ভেতর গ্যাসের চাপ কম হলে অধিক বিভব পার্থক্য প্রয়োগে এক্স-রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই এক্স-রশ্মিকে কঠিন এক্স-রে বলে। এই রশ্মির ভেদন ক্ষমতা খুবই বেশি। পদার্থের গঠন প্রকৃতি নির্ণয়ে এবং বিভিন্ন গবেষণা কার্যে এর ব্যবহার সর্বাধিক।

এক্স-রের একক (Unit of X-rays)

এক্স-রে বিকিরণ পরিমাপ করার জন্য যে একক ব্যবহার করা হয় তাকে রন্টজেন বলা হয়। এক রন্টজেন বলতে সেই পরিমাণ বিকিরণ বুঝায় যা স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় এক মিলিমিটার বায়ুতে এক স্থির বৈদ্যুতিক আধানের সমান আধান উৎপন্ন করতে পারে।

এক্স-রে উৎপাদন (Production of X-rays)

আমরা জানি যে, ক্যাথোড রশ্মি দ্রুত গতিসম্পন্ন ইলেকট্রন ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্রুতগতিসম্পন্ন ইলেকট্রন সহসা কঠিন ধাতব পদার্থে আঘাত করলে তা হতে এক্স-রে উৎপন্ন হয়।

এক্স-রে উৎপাদনের জন্য তিনটি পদ্ধতি আছে; যথা—

(১) গ্যাস নল পদ্ধতি (Gas tube method);

(২) কুলীজ নল পদ্ধতি (Coolidge tube method) ও

(৩) বিটাট্রন পদ্ধতি (Betatron method)।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এক্স-রের ধর্ম (Properties of X-rays)

বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে এক্স-রের নিম্নলিখিত ধর্মসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে–

  • এক্স-রে সরলরেখায় গমন করে।
  • এক্স-রে অদৃশ্য। সাধারণ আলোক রেটিনায় পড়লে দৃষ্টির অনুভূতি জন্মায় কিন্তু এদের ক্ষেত্রে এমন হয় না।
  • এটি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় আড় তরঙ্গ।
  • এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সাধারণ আলোকের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অপেক্ষা ছোট। সাধারণ আলোকের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 10-7 m বা 1000 Å; কিন্তু এদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 10-10 m বা, 1 Å।
  • আলোকের সম-বেগে অর্থাৎ 3 × 108ms-1 বেগে এটি গমন করে।
  • এর ভেদন ক্ষমতা অত্যধিক।
  • ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর এর প্রতিক্রিয়া আছে।
  • এটি প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে।
  • এটি বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয় না। সুতরাং এর মধ্যে কোনো চার্জ নেই।
  • গ্যাসের মধ্য দিয়ে যাবার সময় এটি গ্যাসকে আয়নিত করে।
  • এটি আলোক-বিদ্যুৎ ক্রিয়া প্রদর্শন করে। অর্থাৎ কোনো ধাতব পদার্থে আপতিত হলে তা হতে ইলেকট্রন নির্গত হয়।
  • সাধারণ আলোকের ন্যায় এর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন এবং ব্যবর্তন ঘটে।
  • এটি জীবন্ত কোষকে ধ্বংস করতে পারে।
  • এর প্রভাবে জীবন কোষের জিনের (genes) চারিত্রিক গুণাবলির পরিবর্তন ঘটে।
  • চামড়ার উপর অনেকক্ষণ ধরে এটি আপতিত হলে শরীরের ক্ষতিসাধন করে। তখন এটি রক্তের শ্বেত-কণিকা ধ্বংস করে।
  • X-রশ্মির তীব্রতা ব্যস্তানুপাতিক সূত্র মেনে চলে।

 

 

এক্স-রের ব্যবহার (Uses of X-rays)

আধুনিক বিজ্ঞান জগতে এক্স-রের ব্যবহার একটি অমূল্য অবদান। নিম্নে এক্সরে-এর বিভিন্ন প্রয়োগের বিবরণ দেয়া হলো।

(১) চিকিৎসাক্ষেত্রে (In medical science) : শরীরের কোনো অংশের হাড় স্থানচ্যুত হলে, হাড় ভেঙ্গে গেলে বা শরীরের কোনো অংশে অবাঞ্ছিত কোনো বস্তু প্রবেশ করলে এক্সরে দ্বারা তা ধরা যায়। দাঁতের ক্ষয় এবং দাঁতের গোড়ায় ক্ষত নির্ণয়ে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। আলসার, ক্যান্সার, টিউমার, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগ নির্ণয় এক্স-রের সাহায্যে করা যায়। এ ছাড়া জীব কোষ ধ্বংসের কাজে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়।

(২) গোয়েন্দা বিভাগ (In detective departments) : কোনো কাঠের বাক্স বা চামড়ার থলির মধ্যে লুকানো বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র বা নিষিদ্ধ দ্রব্য থাকলে এক্স-রের সাহায্যে তা নির্ণয় করা যায়। তা ছাড়া কোনো দুষ্কৃতিকারীর পেটে সোনা, রূপা, মুক্তা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু থাকলে এক্স-রের সাহায্যে তা চিহ্নিত করা যায়।

(৩) শিল্প ক্ষেত্রে (In industry) : কোনো ধাতব পাতের অভ্যন্তরে কোনো ফাটল বা গর্ত নির্ণয়ের জন্য, প্রকৃত এবং নকল হীরকের পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য, ঝিনুকের মধ্যে মুক্তার অবস্থান নির্ণয়ের জন্য, ঢালাইয়ের কোনো খুঁত নির্ধারণের জন্য এবং ঝালাইয়ের ত্রুটি নির্ণয়ের কাজে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়। আজকাল চামড়া শিল্পে এক্স-রে ব্যবহৃত হচ্ছে।

(৪) ব্যবসায়ে (In commerce) : আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য উন্নত দেশসমূহে লজেন্স, টফি, কেক প্রভৃতি খাদ্য তৈরির পর এক্স-রের সাহায্যে তা পরীক্ষা করা হয়। অনেক সময় অবাঞ্ছিত দ্রব্য এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে খাদ্যদ্রব্য বিষাক্ত করে ফেলে। এক্স-রে এই বিপদ দূর করতে সাহায্য করে ব্যবসায়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখে।

(৫) পরীক্ষাগারে (In laboratory) : পরমাণুর গঠন, কেলাসের গঠন এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এক্স-রে ব্যবহৃত হয়।

এ সম্পর্কিত আরও কিছু প্রশ্নঃ–

  • এক্সরে কাকে বলে?
  • X-ray উৎপাদনে কোন রশ্মি ব্যবহৃত হয়?
  • রঞ্জন রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত?
  • এক্স-রে আবিষ্কার হয় কত সালে?
  • এক্সরে কে আবিষ্কার করেন?
  • এক্সরে কিভাবে কাজ করে?
  • এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফির পার্থক্য কি?
  • এক্সরে কেন করা হয়?
  • এক্সরের ক্ষতিকর দিক কী কী?
  • এক্সরে করতে কত টাকা লাগে?