লাইকেন হচ্ছে একটি শৈবাল ও একটি ছত্রাকের সহঅবস্থান। শৈবাল ও ছত্রাক পরস্পর এমনভাবে সংযুক্ত থাকে যে দেখে মনে হয় যেন এরা একটি উদ্ভিদ। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ছত্রাক ও একটি সালোকসংশ্লেষণকারি নির্দিষ্ট প্রজাতির শৈবাল যখন একসাথে বসবাস করে একটি থ্যালাস সৃষ্টি করে তখন তাকে লাইকেন বলে। এখানে ছত্রাক ও শৈবাল পরস্পর অন্যোন্যজীবী বা মিথোজীবীরূপে (Symbiotically) বসবাস করে। এ ধরনের বন্ধনে উভয়েই একে অপরের দ্বারা উপকৃত হয়। Lichen শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Leichen থেকে, যার অর্থ হলাে “শৈবালতুল্য পুষ্পক ছত্রাক বিশেষ”
লাইকেনের প্রকারভেদ
১. ক্রাসটোজ লাইকেন– পোষক বস্তুর সাথে নিবিড়ভাবে লেগে থাকে।
২. ফোলিয়োজ লাইকেন– এরা দেখতে বিষমপৃষ্ঠ পাতার মত।
৩. ফ্রুটিকোজ লাইকেন– শাখাযুক্ত, খাড়া অথবা ঝুলন্ত দেহের হয়।
৪. লেপ্রোজ লাইকেন– এই লাইকেন পাথরের উপর পাউডারের মত জন্মায়।
লাইকেনের বিস্তৃতি
বিভিন্ন ধরনের পরিবেশে জীবন ধারণে সক্ষম বলে লাইকেনকে বিশ্বজনীন হিসেবে শনাক্ত করা যায়। সাধারণত মাটি, গাছের বাকল, পুরাতন দেয়াল, নগ্ন পাথর কিংবা পাহাড়ের গায়ে প্রচুর পরিমাণে লাইকেন জন্মায়। সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তের কাছাকাছি প্রচন্ড রকমের ঠান্ডা পরিবেশেও লাইকেন জন্মাতে পারে। তুন্দ্রা অঞ্চলে বরফাচ্ছাদিত মাটি অথবা পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী লাইকেনের ঘন আস্তরণ রেইনডিয়ার মস নামে পরিচিত। কিছু কিছু প্রজাতি সমুদ্র সৈকতেও জন্মায়। পৃথিবীতে প্রায় ৪০০টি গণ ও ১৬, ০০০ প্রজাতির লাইকেন দেখা যায়।
লাইকেনের বৈশিষ্ট্য
শৈবাল ও ছত্রাকের পারস্পরিক সহযােগিতায় সৃষ্ট স্বতন্ত্র উদ্ভিদেরই নাম লাইকেন। এটি সমাঙ্গদেহী ও বিষম পৃষ্ঠের। এটি বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন বাহ্যিক আকৃতির হয়। শৈবাল সদস্যটি সমগ্র থ্যালাসের ৫% – ১০% ভর বহন করে। লাইকেনে সাধারণত তিন রকমের থ্যালাস দেখা যায়; যথা- ক্রাস্টোজ, ফোলিয়ােজ ও ফ্রুটিকোজ। এদের জনন কাজ সাধারণত ছত্রাক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত অঙ্গজ, অযৌন ও যৌন পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে।
লাইকেনের গঠন
লাইকেন সমাঙ্গদেহী। এরা অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এদের বর্ণ ধূসর, সাদা, কমলা-হলুদ, সবুজ, পীতাভ-সবুজ অথবা কালো। এরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকার থেকে শুরু করে কয়েক ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একটি লাইকেন দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। একটি শৈবাল যাকে ফটোবায়োন্ট (photobiont) বলে এবং একটি ছত্রাক যাকে মাইকোবায়োন্ট (mycobiont) বলা হয়। ছত্রাকটি সাধারণত Ascomycetes শ্রেণির হয় আর শৈবালটি সাধারণত নিলাভ-সবুজ Myxophyceae শ্রেণির হয়ে থাকে। ফটোবায়োন্ট ও মাইকোবায়োন্ট এর সহ-অবস্থানে থ্যাল্যাস (thallus)-এর মতো উদ্ভিদ দেহ গঠন করে। বর্ধন রীতি, দেহের বাহ্যিক গঠন এবং অবলম্বনের সাথে সংলগ্নতার রীতি অনুযায়ী লাইকেন থ্যালাস প্রধানত নিম্নবর্ণিত তিন ধরনের হয়ে থাকে–
১। ক্রাস্টোজ (Crustose): পাহাড়ের নগ্ন ঢাল, প্রস্তর খণ্ড, পুরাতন অট্টালিকা বা উদ্ভিদের বাকলে ঘনিষ্টভাবে সংলগ্ন পাতলা আস্তরণের আকারে বিস্তৃত লাইকেনকে ক্রাস্টোজ লাইকেন বলে। যেমন- Graphis, scripta, Lecanora, Strigula ইত্যাদি।
২। ফোলিয়োজ (Foliose): এরা বিষম পৃষ্ঠের, কিনারা খন্ডিত, প্রশস্ত, চ্যাপ্টা ও মুক্ত। এদের নিম্নতলে রাইজয়েড সদৃশ্য রাইজান বের হয়।যেমন– Xanthoria, Peltigera, Parmelia ইত্যাদি।
৩। ফ্রুটিকোজ (Fruticose): এরা ব্যাপকভাবে শাখাযুক্ত। এরা খাড়া অথবা ঝুলন্ত দেহের হয় এবং দেখতে অনেকটা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের ন্যায়। যেমন– Cladonia, Usnea ইত্যাদি।
লাইকেনের অন্তর্গঠন
নিচে একটি ফোলিয়োজ লাইকেনের অন্তর্গঠন সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ
উর্ধ্ব কর্টেক্সঃ এ অঞ্চলটি ছত্রাকের অসংখ্য হাইফি দিয়ে গঠিত। হাইফি অত্যন্ত ঘনভাবে বিন্যাস্ত থাকে বলে হাইফির মাঝে কোন ফাঁক নেই। ফাঁক থাকলেও ফাঁক স্থানগুলো মিউসিলেজ জাতীয় পদার্থ দ্বারা পূর্ণ রয়েছে। এ অঞ্চল বেশ পুরু এবং বহিত্বকের মতো কাজ করে।
শৈবাল স্তরঃ এ অংশে অল্প সংখ্যক হাইফি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শৈবাল থাকে। তাই এ অংশটি সবুজ বা নীলাভ সবুজ বর্ণের দেখায়। একটি প্রজাতির লাইকেনে সর্বদাই এক ধরনের শৈবাল থাকে। কতকগুলো প্রজাতিতে হাইফি হতে শৈবালের কোষে হস্টোরিয়া প্রবেশ করে দেয়।
মেডুলাঃ শৈবাল অঞ্চলের নিচে অত্যন্ত ফাঁকাভাবে বিন্যস্ত ছত্রাকের হাইফি দিয়ে গঠিত একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলের হাইফির প্রাচীর বেশ পুরু। হাইফি থ্যালাসের প্রান্তের দিকে বেশ পাতলা কিন্তু কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট। মেডুলা অঞ্চলের হাইফির শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত।
নিম্ন কর্টেক্সঃ মেডুলার নিচে ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট এবং থ্যালাসের সাথে উল্লম্ব বা অনুভূমিক তলে বিস্তৃত ছত্রাকের হাইফিকে নিম্ন কর্টেক্স বলে। এ অঞ্চল থেকেই রাইজয়েড সদৃশ উপবৃদ্ধি বা রাইজানগুলোর জন্ম হয়। রাইজানগুলো লাইকেন থ্যালাসকে অবলম্বনের সাথে সংলগ্ন রাখে এবং খাদ্যরস শোষণ করে।
লাইকেনের গুরুত্ব
উপকারী ও অপকারী উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রকৃতিতে লাইকেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপকারী ভূমিকাঃ বড় বড় পর্বত গাত্রে জন্মানাে ক্রাস্টোজ লাইকেন সেখানে সূক্ষ্ম ফাটলের সৃষ্টি করে। লাইকেন কর্তৃক নিঃসৃত CO২, এর সাথে বৃষ্টির পানি অথবা জলীয় বাষ্প মিশে কার্বনিক এসিড উৎপন্ন হয় যা পর্বতের ক্ষয় সাধন করে। ফলে পাথর বিচুর্নিত হয়। সেখানে লাইকেনের মৃত দেহাবশেষ জমে হিউমাস গঠিত হয় যা উন্নত উদ্ভিদ জন্মানাের উপযােগী মাটির সৃষ্টি করে। এভাবে উদ্ভিদের মরুজ ক্রমাগমনে লাইকেনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। “রেইনডিয়ার মস” নামে পরিচিত লাইকেন বল্গা হরিণ এবং কোনাে কোনাে গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া লাইকেনের কিছু সদস্য, যেমন- Calcaria, Lichenora ইতাদি নানা ধরনের কীটপতঙ্গের শুককীট ও শামুকের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি প্রজাতির (যেমন- Centraria islandica) লাইকেন দেহে “লাইকেনিন” নামক শর্করা থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জলাতঙ্কের ঔষধ হিসেবে Pelligera এবং হুপিং কফের নিরাময়ের জন্য Cladonia নামক লাইকেন ব্যবহৃত হয় । এছাড়াও সুগন্ধি ও প্রসাধনীর উপকরণ, রং এর উৎস উত্তেজক পদার্থ তৈরি, টানিং ইত্যাদি কাজেও লাইকেন ব্যবহৃত হয়।
অপকারী ভূমিকাঃ পুরাতন অট্টালিকার গায়ে অথবা মার্বেল পাথরের তৈরি সৌধে বসবাসকারী লাইকেন অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু লাইকেন বিষাক্ত; তাই এসব খেয়ে অনেক গবাদি পশু এমনকি মানুষও অনেক সময় মারা যায়। Usnea, Cladonia ইত্যাদি লাইকেনের কোনাে কোনাে প্রজাতি তাদের আশ্রয়দাতা উদ্ভিদের ক্ষতি করে