সমাজ ও সভ্যতার অনন্য অবদান হচ্ছে ভাষা। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও, সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত ছিল না। নানারকম জীবজন্তুর ভয়ে তারা গাছের ডালে বা পাহাড় পর্বতে বাস করত। তখন তারা বিপদে পড়লে নানারকম অঙ্গভঙ্গি বা ইঙ্গিতের সাহায্যে একে অপরকে প্রকাশ করত কিন্তু এগুলো ভাষা নয়। এর মাধ্যমে মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা যেত না। একারণে শুরু হলো সংকেতের ধ্বনিরূপ। আর এ ধ্বনিই হলো ভাষার মূল উপাদান। এ ধ্বনির সাহায্যেই ভাষার সৃষ্টি হয়। চলুুুন তাহলে ভাষা কি বা কাকে বলে? ভাষার বৈশিষ্ট্য সমূহ, ভাষার কাজ ও বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
ভাষা কি বা কাকে বলে?
ভাষা কি কাকে বলে? বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাক সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলে। অর্থাৎ, বাগযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনি সকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তাকে ভাষা বলে।
ড. সুকুমার সেনের মতে, মনের ভাব প্রকাশ করার নিমিত্ত বিভিন্ন জাতির বা সমাজের সকল সভ্যের বোধগম্য বাক্যসমূহের সমষ্টিকে ভাষা বলে।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্তি শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে।
ড. মুহম্মদ আবদুল হাই এর মতে, এক এক সমাজের সকল মানুষের অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।
সুতরাং বলা যায়, বাগযন্ত্রের সাহায্যে (নাক, কন্ঠ, তালু,দাঁত, জিহ্বা ইত্যাদি) উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনি সমষ্টিই হলো ভাষা।
আশা করি ভাষা কি বা কাকে বলে নিয়ে আমরা জেনে গেলাম। এবার আমরা ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো শিখে ফেলব।
ভাষার বৈশিষ্ট্য সমূহ
মানুষের আগমনের বহুকাল পরে ভাষার সৃষ্টি হয়। আগে মানুষ তাদের মনের ভাব নানারকম অঙ্গভঙ্গি বা ইঙ্গিতের সাহায্যে প্রকাশ করত কিন্তু এগুলো ভাষা নয়। মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। যেমন –
কন্ঠনিঃসৃত ধ্বনির সাহায্যে ভাষার সৃষ্টি হয়।
ভাষার অর্থদ্যােতক থাকতে হবে।
সব ধরণের ধ্বনিই ভাষা হতে পারে না, যেসব ধ্বনি বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত হয়, শুধু সেগুলোই ভাষার সৃষ্টি করে।
সেসব ধ্বনিই ভাষা যা বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ভাবের প্রতীক।
ভাষা বহুজনবোধ্য।
ভাষা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়।
পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি ও ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষা কাজ করে।
ভাষা তার নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব।
দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে ইত্যাদি।
ভাষার প্রকারভেদ
ভাষার দুটি রূপ দেখা যায়। যথাঃ
- মৌখিক বা কথ্য ভাষা (এ ভাষার লিখন ব্যবস্থা নেই)
- লৈখিক বা লেখ্য ভাষা (এ ভাষার লিখন ব্যবস্থা আছে)
মৌখিক রূপেরও একাধিক রীতি রয়েছে। যেমন-
- চলিত কথ্য রীতি
- আঞ্চলিক কথ্য রীতি
বাংলা ভাষার লৈখিক বা লেখ্য রূপের ২ টি রীতি আছে। যথাঃ
- সাধু রীতি / ভাষা
- চলিত রীতি / ভাষা
সাধু রীতিঃ সাধু পণ্ডিতদের দ্বারা কৃত্রিমভাবে তৈরিকৃত লিখার উপযোগী ভাষাকে সাধু রীতি ভাষা বলা হয়।
চলিত রীতি / ভাষাঃ বর্তমানে সবকিছু (বই, পত্রিকা, পোস্টার ইত্যাদি) যে ভাষায় প্রকাশ হয় তাকে চলিত রীতি বা ভাষা বলে।
সাধু ও চলিত রীতির মাঝে পার্থক্য
সাধু ভাষা / রীতি | চলিত ভাষা / রীতি |
সাধু পণ্ডিতদের দ্বারা কৃত্রিমভাবে তৈরিকৃত লিখার উপযোগী ভাষাকে সাধু রীতি ভাষা বলা হয়। | বর্তমানে সবকিছু (বই, পত্রিকা, পোস্টার ইত্যাদি) যে ভাষায় প্রকাশ হয় তাকে চলিত রীতি বা ভাষা বলে। |
এ রীতি গুরুগম্ভীর ও তৎসম শব্দ বহুল। | এ রীতি তদ্ভব শব্দ বহুল। |
এ ভাষা ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চলে এবং অপরিবর্তনশীল। | এ ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে চলে না এবং পরিবর্তনশীল। |
এ ভাষা নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার জন্য অনুপযোগী। | নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার জন্য বেশি উপযোগী। |
আঞ্চলিক প্রভাব মুক্ত। | আঞ্চলিক প্রভাব যুক্ত। |
এ রীতির প্রচারক হলো রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি। | চলিত গদ্যের প্রচারক হলো প্রমথ চৌধুরী। |
সমাসবহুল শব্দ বেশি। | সমাসবহুল শব্দ কম। |
এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ বিশেষ গঠনপদ্ধতি মেনে চলে। | সাধু রীতিতে ব্যবহৃত সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ চলিত রীতিতে পরিবর্তিত ও সহজতর রূপ লাভ করে। অনেক বিশেষ্য ও বিশেষণের ক্ষেত্রেও এমন ঘটে। |
ক্ষুদ্রার্থক শব্দ নারীবাচক হয়। ইত্যাদি। | ক্ষুদ্রার্থক শব্দ নারীবাচক হয় না। ইত্যাদি। |
সাধু থেকে চলিত রীতিতে পরিবর্তন
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
মস্তক | মাথা |
করিবার | করবার / করার |
দেখিয়া | দেখে |
পড়িল | পড়লো / পড়ল |
জুতা | জুতো |
সহিত | সাথে / সঙ্গে |
দেন নাই | দেননি |
বন্য | বুনো |
তাঁহারা | তাঁরা |
উহাকে | ওকে |
ভাষার কাজ কি?
ভাষার কাজ হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। এর সাহায্যে মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করে। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের মধ্যমই হলো এই ভাষা। এতে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে কারো সুবিধা ও অসুবিধা জানা যায়। এভাবেই ভাষা সমাজ গড়ে তুলে। সমাজ গঠনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভাষা। তাছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতিতেও এর অবদান অপরিসীম। এর সাহায্যে আমরা লেখাপড়া করি, জ্ঞান অর্জন করি, সাহিত্য সৃষ্টি করি। এক কথায় ভাষা ছাড়া চলা অসম্ভব।
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার
বাংলা ভাষায় যে শব্দসম্ভারের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ
তৎসম শব্দ
অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন তৎসম শব্দ
তদ্ভব বা প্রাকৃত শব্দ
দেশি শব্দ
বিদেশী শব্দ
তৎসম শব্দ: তৎ অর্থ “তার” আর সম অর্থ “সমান”। অর্থাৎ তৎসম শব্দের অর্থ তার সমান বা সংস্কৃতের সমান। যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে কোন রূপ পরিবর্তন ছাড়াই সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে তাদেরকে তৎসম শব্দ বলা হয়। যেমন – সিংহ, পুত্র, রাজা, শিশু, মাতা, আকাশ, শিক্ষা ইত্যাদি। ড. মোঃ এনামুল হকের মতে বাংলা ভাষার 25% শব্দ তৎসম।
উত্তর: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য।
৬. বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে কোন দশকে?
- খ্রিষ্টিয় দশম শতকের কাছাকাছি
- খ্রিষ্টিয় নবম শতকের কাছাকাছি
- খ্রিষ্টিয় চতুর্থ শতকের কাছাকাছি
- খ্রিষ্টিয় অষ্টম শতকের কাছাকাছি
উত্তর: খ্রিষ্টিয় দশম শতকের কাছাকাছি
৭. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল কত?
- ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ
উত্তর: ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ
৮. ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল কত?
- ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ
- ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ
উত্তর: ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ
৯. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা ভাষার উৎস কোন অপভ্রংশ থেকে?
- গৌড় প্রাকৃত থেকে
- মাগধি প্রাকৃত থেকে
- অপভ্রংশ থেকে
- গৌড় অপভ্রংশ থেকে
উত্তর: গৌড় অপভ্রংশ থেকে
১০. অনেকেই কোন ভাষাকে বাংলার জননী মনে করত?
- প্রাকৃত
- সংস্কৃত
- গৌড়
- তৎসম
উত্তর: সংস্কৃত
১১. ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর কততম বৃহৎ মাতৃভাষা?
- প্রথম
- তৃতীয়
- চতুর্থ
- পঞ্চম
উত্তরঃ চতুর্থ
১২. বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিস্তৃত ইতিহাস রচনা করেন কে?
- রাজা রামমোহন রায়
- ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- প্রমথ চৌধুরী
উত্তর: ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়